২০২৫ সালের জুন মাসে সোনার (Gold) এক্সচেঞ্জ-ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ) গুলিতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহে তীব্র পুনরুত্থান দেখা গেছে। অ্যাসোসিয়েশন অফ মিউচুয়াল ফান্ডস ইন ইন্ডিয়া (AMFI)-এর তথ্য অনুযায়ী, এই মাসে নেট ইনফ্লো হয়েছে ২,০৮০.৮৫ কোটি টাকা, যা জানুয়ারি মাসের পর সর্বোচ্চ।
এটি একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, কারণ এপ্রিল মাসে সোনার ইটিএফ থেকে মাত্র ৫ কোটি টাকার আউটফ্লো (বাহির হওয়া বিনিয়োগ) রেকর্ড হয়েছিল। মার্চ এবং এপ্রিল মাসে কিছুটা স্থবিরতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল, যেখানে বিনিয়োগকারীরা মুনাফা তুলে নেওয়ার প্রবণতা দেখিয়েছিলেন। তবে জুনে সেই প্রবণতার উল্টো ছবি দেখা গেল।
কেন এই হঠাৎ পুনরুত্থান?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতার পেছনে একাধিক আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় কারণ কাজ করছে। ভারত বুলিয়ন অ্যান্ড জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (IBJA) ভাইস প্রেসিডেন্ট অক্শা কম্বোজ বলেন, “সোনার ইটিএফ-এ এই শক্তিশালী প্রত্যাবর্তন বিনিয়োগকারীদের চিরাচরিত নিরাপদ বিনিয়োগের প্রতি আস্থা প্রকাশ করছে। এপ্রিল মাসের পতনের পর এই পুনরুদ্ধার দেখায় যে বিনিয়োগকারীরা আবারও সোনাকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচনা করছে।”
বিশেষজ্ঞরা আরও জানাচ্ছেন, মে মাসে সামান্য পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে প্রায় ২৯১.৯১ কোটি টাকার নেট ইনফ্লো হয়। কোটাক AMC-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ফান্ড ম্যানেজার সতীশ ডোণ্ডাপাটি বলেন, “মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে মুনাফা তুলে নেওয়ার পর বিনিয়োগকারীরা পুনরায় সোনায় ফিরেছেন, যার প্রতিফলন জুন মাসের এই শক্তিশালী ইনফ্লো-তে দেখা যাচ্ছে।”
নতুন ইটিএফ লঞ্চের প্রভাব:
জুন মাসে দুটি নতুন সোনার ইটিএফ চালু হয়েছে, যা থেকে ৪১ কোটি টাকা তোলা হয়েছে। যদিও নতুন লঞ্চ থেকে আসা অর্থ তুলনামূলকভাবে ছোট, তবুও এটি সামগ্রিকভাবে সোনার ইটিএফ-এ পুনরুত্থানকে ত্বরান্বিত করেছে। মর্নিংস্টার ইনভেস্টমেন্ট রিসার্চ ইন্ডিয়ার সিনিয়র অ্যানালিস্ট নেহাল মেশ্রম বলেন, “২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে সোনার ইটিএফ-এ নেট ইনফ্লো ৮,০০০ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। এটি প্রমাণ করে যে বিনিয়োগকারীরা এখন সোনাকে দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ বণ্টন কৌশলের অংশ হিসেবে আরও গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন।”
সোনার দরবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অস্থিরতার ভূমিকা:
সোনার দরবৃদ্ধি, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং শেয়ার ও বন্ড মার্কেটে অস্থিরতা—এই তিনটি কারণ মিলে সোনার প্রতি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ বাড়িয়েছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকায়, এটি লাভজনক বিনিয়োগের বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে।
নেহাল মেশ্রম বলেন, “জুন মাসের শক্তিশালী ইনফ্লো বিনিয়োগকারীদের মানসিকতায় একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে সোনাকে একমাত্র নিরাপদ বিনিয়োগ না ভেবে, দীর্ঘমেয়াদি পোর্টফোলিও ডাইভার্সিফিকেশনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করছেন।”
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা:
বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রবণতা আগামী মাসগুলোতেও অব্যাহত থাকতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তোলপাড়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার পরিবর্তন, চীনের অর্থনৈতিক গতি এবং ইউরোপের রাজনৈতিক অস্থিরতা—সব মিলিয়ে সোনার দাম এবং বিনিয়োগে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।
কোটাক AMC-এর সতীশ ডোণ্ডাপাটি আরও বলেন, “যদি বৈশ্বিক অর্থনীতি অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে এবং শেয়ার বাজারে অস্থিরতা বাড়ে, তবে সোনার ইটিএফ-এ বিনিয়োগ বাড়তে থাকবে। এটি মূলত সেইসব বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় যারা পোর্টফোলিওতে ঝুঁকি কমিয়ে স্থিতিশীল আয় চায়।”
অন্যদিকে, IBJA-এর অক্শা কম্বোজ আশাবাদী মন্তব্য করে বলেন, “বর্তমানে যেভাবে সোনার ইটিএফ-এ বিনিয়োগ বাড়ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও সচেতনভাবে সোনার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। আগামী দিনে এই ধারা আরও জোরদার হবে।”
অতীতের তুলনায় জুন মাসের এই রেকর্ড ইনফ্লো স্পষ্ট করে যে বিনিয়োগকারীরা সোনাকে নতুন করে মূল্যায়ন করছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি, দেশীয় অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা মিলিয়ে সোনার ইটিএফ-এর ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল বলেই মনে করা হচ্ছে।
এই প্রবণতা কেবল স্বর্ণের বাজারকেই চাঙ্গা করছে না, বরং ভারতীয় মিউচুয়াল ফান্ড ইন্ডাস্ট্রিরও সমৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। ২০২৫ সালের বাকি সময় জুড়ে এই ধারা বজায় থাকে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।