ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতিকে বদলে দেওয়ার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেস বা UPI। শুধু দেশে নয়, এখন এটি ভারতের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। অতি দ্রুত পিয়ার-টু-পিয়ার (P2P) এবং পিয়ার-টু-মার্চেন্ট (P2M) লেনদেনের সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি, ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (NPCI) UPI-তে নানা নতুন ফিচার যোগ করেছে যা সাধারণ পেমেন্ট সেবাকে এক নতুন স্তরে নিয়ে গেছে।
এই নতুন ফিচারগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রস-বর্ডার পেমেন্টস, লোন এবং ইন্স্যুরেন্স সার্ভিসের সঙ্গে ইন্টিগ্রেশন, এবং আরও বিভিন্ন ধরনের বিশেষ সুবিধা। এর ফলে UPI শুধু একটি পেমেন্ট সিস্টেম হিসেবে সীমাবদ্ধ না থেকে ভারতের ডিজিটাল রূপান্তরের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে UPI-এর সাফল্য:
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ত্রিনিদাদ ও টোবাগো সফরে (৩-৪ জুলাই) UPI-এর আন্তর্জাতিক সাফল্য আরও একবার দৃশ্যমান হলো। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (MEA) দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “দুই দেশই ডিজিটাল ক্ষেত্রের সহযোগিতা বাড়াতে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী ত্রিনিদাদ ও টোবাগো-কে অভিনন্দন জানিয়েছেন, কারণ তারা প্রথম ক্যারিবিয়ান দেশ হিসেবে ভারতের UPI সিস্টেমকে গ্রহণ করেছে।”
এছাড়াও দুই দেশের মধ্যে ডিজিটাল গভর্নেন্স এবং পাবলিক সার্ভিস ডেলিভারির ক্ষেত্রেও যৌথভাবে কাজ করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, ইন্ডিয়া স্ট্যাক সলিউশন যেমন ডিজিলকার, ই-সাইন এবং গভর্নমেন্ট ই-মার্কেটপ্লেস (GeM) এর বাস্তবায়নেও ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে। তাছাড়া, তারা রাষ্ট্রের জমি রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়ার ডিজিটালাইজেশন এবং সিস্টেম আপগ্রেডের জন্যও ভারতের সহায়তা চেয়েছে।
ইউরোপেও UPI-এর প্রসার:
এর আগে জুন ২০২৫-এ সাইপ্রাস সফরের সময়ও UPI আন্তর্জাতিক স্তরে নতুন সাফল্যের মুখ দেখেছে। সাইপ্রাসের ইউরোব্যাংকের সঙ্গে NPCI-এর সমঝোতার ভিত্তিতে UPI-এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে ক্রস-বর্ডার পেমেন্ট চালুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এই পদক্ষেপ ভারত এবং সাইপ্রাসের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত করতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দেশীয় অগ্রগতি:
দেশের অভ্যন্তরেও UPI-এর জনপ্রিয়তা ক্রমেই আকাশছোঁয়া হচ্ছে। জুন ২০২৫-এ UPI-এর মাধ্যমে মোট লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪,০৩,৯৩০ কোটি টাকা। বছরে বছরে UPI-এর ট্রানজাকশন ভলিউম এবং ভ্যালুর বৃদ্ধি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা শতকরা হারে নয় বরং বহু গুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গ্রামের মানুষ থেকে শুরু করে শহরের প্রযুক্তিপ্রেমী যুবক— সকলের জন্যই UPI হয়ে উঠেছে আর্থিক লেনদেনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। শুধু তাই নয়, স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের বিস্তারের সাথে সাথে UPI-এর ব্যবহার আরও সহজ এবং সুলভ হয়ে গেছে।
বাজারে UPI নিয়ে উত্তেজনা:
UPI নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আগ্রহও ক্রমবর্ধমান। ভারতের বৃহত্তম ওপিনিয়ন ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম প্রোবো-তে UPI নিয়ে বিভিন্ন ফোরকাস্ট বা অনুমানমূলক চুক্তি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
৭ জুলাই পর্যন্ত প্রোবো-তে একটি ইভেন্ট কন্ট্রাক্টে প্রায় ৩,০০০ সক্রিয় ট্রেডার অংশগ্রহণ করেছেন। তারা জুলাই ২০২৫-এ UPI ট্রানজাকশন ভ্যালু ২৫,০০,০০০ কোটি টাকা বা তার বেশি পৌঁছাবে বলে ৮০% সম্ভাবনা দেখাচ্ছেন। এদিকে, ৭ জুলাই পর্যন্ত NPCI-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট অনুযায়ী ইউপিআই ট্রানজাকশন ভ্যালু ইতিমধ্যে ৬,৬০,১০২ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে।
ডিজিটাল ফিনান্সের ভবিষ্যৎ:
ইউপিআই-এর এই সাফল্য ভারতের অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের সফট পাওয়ার প্রদর্শনেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ইউপিআই-এর মাধ্যমে শুধু লেনদেনই নয়, ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের মধ্যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণও সম্ভব হচ্ছে।
ভারতের উদ্ভাবনী শক্তি এবং প্রযুক্তি সক্ষমতার অন্যতম উদাহরণ হিসেবে ইউপিআই বিশ্ব দরবারে ভারতের পরিচয়কে আরও শক্তিশালী করছে। ভবিষ্যতে আরও বেশি দেশ এই প্রযুক্তি গ্রহণ করলে, একদিকে যেমন ভারতের সঙ্গে তাদের আর্থিক সম্পর্ক মজবুত হবে, অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতেও ভারতের অবদান বাড়বে।
এই সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার এবং NPCI আরও নতুন ফিচার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দিকে নজর দিচ্ছে। যেমন ডিজিলকার, ই-সাইন, GeM ইত্যাদির মাধ্যমে ডিজিটাল গভর্নেন্স এবং সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার কাজও সহজ হবে।
সবমিলিয়ে বলা যায়, ইউপিআই ভারতের প্রযুক্তি এবং আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় সাফল্যের গল্পগুলির একটি। এর সম্প্রসারণ, জনপ্রিয়তা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আগামী দিনে ভারতকে একটি বিশ্বমানের ফিনটেক হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।