ভারত ও আমেরিকার মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্ব আরও গভীর করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সফর শেষ করলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রী (Vikram Misri)। ২৭ মে থেকে ২৯ মে পর্যন্ত তাঁর এই সফরে প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য এবং আর্থিক খাতে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা জোরদার করতে উচ্চপর্যায়ের একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এই সফরের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে, কারণ এটি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ১৩ ফেব্রুয়ারির যুক্তরাষ্ট্র সফরের পরপরই ঘটল, যেখানে “India-US COMPACT” নামক একটি নতুন উদ্যোগ চালু করা হয়। এই COMPACT-এর লক্ষ্য হল প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক বিকাশে দুই দেশের যৌথ অগ্রগতি নিশ্চিত করা।
গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু: প্রযুক্তি ও বাণিজ্য
এই সফরে পররাষ্ট্র সচিব মিশ্রী ও উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পবন কাপুরের নেতৃত্বে ভারতীয় প্রতিনিধি দল মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জেফ্রি কেসলারের সঙ্গে বৈঠক করেন। আলোচনায় ক্রিটিক্যাল ও উদীয়মান প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
দুই দেশই আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন (ITAR) ও অন্যান্য রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলির সরলীকরণের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছে, যাতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের নতুন সুযোগ উন্মোচিত হয়। তদুপরি, Strategic Trade Dialogue-এর পরবর্তী পর্ব যত দ্রুত সম্ভব অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
উচ্চ পর্যায়ের আন্তঃবিভাগীয় বৈঠক
পররাষ্ট্র সচিব মিশ্রী যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ—স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল, ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স, ট্রেজারি ও কমার্স—এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই সব বৈঠকে একটিই বার্তা স্পষ্ট করে তোলা হয়—”প্রযুক্তি, বাণিজ্য ও প্রতিভা হবে ভারত-মার্কিন অংশীদারিত্বের মূল স্তম্ভ।”
এক বিশেষ মধ্যাহ্নভোজে, যা আয়োজিত হয়েছিল মার্কিন উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টোফার ল্যান্ডাউ-এর পক্ষ থেকে, সমগ্র দ্বিপাক্ষিক এজেন্ডা পর্যালোচনা করা হয়। এদিন ভারত-মার্কিন ভবিষ্যৎ সম্পর্কের রূপরেখা নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিরক্ষা ও আর্থিক ক্ষেত্রেও অগ্রগতি
প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রেও বড় অগ্রগতি দেখা গেছে। মার্কিন ডেপুটি সেক্রেটারি অফ ডিফেন্স স্টিভ ফেইনবার্গ এবং আন্ডার সেক্রেটারি এলব্রিজ কোলবির সঙ্গে বৈঠকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে প্রতিরক্ষা উপকরণ ‘কো-ডেভেলপ’ এবং ‘কো-প্রডিউস’ করার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এছাড়াও লজিস্টিকস ও তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে সেনা বাহিনীর পারস্পরিক ‘ইন্টারঅপারেবিলিটি’ বৃদ্ধির দিকেও জোর দেওয়া হয়।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে মার্কিন উপ-ট্রেজারি সেক্রেটারি মাইকেল ফলকেন্ডারের সঙ্গে বৈঠকে গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনগুলোতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও FATF প্রক্রিয়াতে সমন্বয়ের বিষয়ে আলোচনা হয়।
কৌশলগত মঞ্চ ও শিল্পমহলের অংশগ্রহণ
COMPACT-এর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একাধিক আন্তঃবিভাগীয় আলোচনায় জ্বালানি নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী উদ্যোগ, ভারত মহাসাগরীয় কৌশলগত উদ্যোগ, ও QUAD, I2U2, IMEEC-এর মতো কৌশলগত প্ল্যাটফর্মগুলিতে পারস্পরিক সমন্বয়ের বিষয়ে মতবিনিময় হয়।
পররাষ্ট্র সচিব মিশ্রী এবং উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কাপুর শীর্ষস্থানীয় শিল্প নেতাদের সঙ্গে একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। এখানে উদীয়মান প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগ ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
এছাড়াও, আমেরিকার প্রভাবশালী থিঙ্ক ট্যাঙ্কদের সঙ্গে একটি ইন্টারঅ্যাকশন সেশনে ভারত-মার্কিন কৌশলগত সম্পর্কের পূর্ণ মাত্রা ও ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে মনোময় আলোচনা হয়।
এই সফরের শেষে একজোটে একটি বার্তা আবারও স্পষ্ট হয়ে ওঠে—”প্রযুক্তি, বাণিজ্য এবং প্রতিভা—এই তিনটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করেই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারিত্ব ২১শতকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”
এই সফর শুধু দুই দেশের মধ্যে গভীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার নিদর্শন নয়, বরং বিশ্বমঞ্চে এক নতুন শক্তিশালী জোট গঠনের পূর্বাভাস। পররাষ্ট্র সচিব মিশ্রীর এই কূটনৈতিক পদক্ষেপ ভবিষ্যতে ভারত-আমেরিকা সম্পর্ককে আরও এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে, এ নিয়ে সন্দেহ নেই।