২০২৫ সালের জুন মাসে ভারতীয় শেয়ারবাজারে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা (Foreign Institutional Investors) পুনরায় বড় আকারে বিনিয়োগ শুরু করেছে। জুন ২৭ পর্যন্ত FIIs প্রায় ৮,৯১৫ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে বলে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন। এই বিনিয়োগ প্রবাহ বাজারে ইতিবাচক বার্তা পাঠিয়েছে এবং সূচকগুলোকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।
বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ পরিবেশের পরিবর্তন এবং কিছু ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত হওয়ার কারণে এই বিনিয়োগের গতি বেড়েছে। ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যে সাময়িক যুদ্ধবিরতি এবং অপরিশোধিত তেলের দামের হঠাৎ পতন বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদে বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়িয়েছে।
একইসঙ্গে, ডলার সূচক ৯৭-এর নিচে নেমে এসেছে, যা উদীয়মান বাজারগুলিতে বিনিয়োগকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা IANS জানিয়েছে, এই পরিস্থিতিতে ভারতের শেয়ারবাজার বিশেষভাবে লাভবান হয়েছে।
জিওজিত ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের চিফ ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট ড. ভি কে বিজয়কুমার বলেন, “ডলারের দরপতন সবসময় উদীয়মান বাজারের জন্য ইতিবাচক। এটি FIIs-কে ভারতে শেয়ার কিনতে উৎসাহিত করেছে।”
বড় মূলধনী শেয়ারের উত্থান
FIIs মূলত ফাইনান্সিয়াল, ক্যাপিটাল গুডস এবং রিয়েল এস্টেট সেক্টরে বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে, FMCG, কনজিউমার ডিউরেবল এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে তারা কিছুটা বেরিয়ে এসেছে। এই সেক্টরগুলিতে তাজা মূলধন প্রবাহের কারণে বড় মূলধনী শেয়ারগুলির দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে এবং সেনসেক্স ও নিফটি নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছে।
তবে শেয়ারবাজারে আশাবাদী ধারা থাকা সত্ত্বেও, FIIs বন্ড বাজারে বিক্রির ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ডের আয় হারের ব্যবধান কমে যাওয়ার কারণে FIIs এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ড. বিজয়কুমার সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, “উচ্চ মূল্যায়ন সর্বদা মুনাফা তুলে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে। যদিও তরলতা এবং ইতিবাচক বিনিয়োগের মানসিকতা বাজারকে শক্তি জোগাতে পারে, তবে অত্যধিক মূল্যায়ন ভবিষ্যতে উর্ধ্বগতি সীমিত করতে পারে।”
দেশের অর্থনৈতিক শক্তি বাড়াচ্ছে আস্থা
ভারতের অর্থনৈতিক ভিত শক্ত এবং এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বজায় রাখতে বড় ভূমিকা পালন করছে। BDO ইন্ডিয়ার পার্টনার ও ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসেস ট্যাক্স লিডার মনোজ পুরোহিত জানিয়েছেন, “নিয়ন্ত্রক সংস্থা SEBI’র মতো কর্তৃপক্ষের কার্যকর ভূমিকা ভারতীয় বাজারকে স্বচ্ছ এবং সহজলভ্য করে তুলেছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে।” তিনি আরও বলেন, “ভারত বিশ্বের অন্যতম দ্রুততম বর্ধনশীল ও স্থিতিশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।”
দেশীয় অর্থনৈতিক সূচকগুলোও বাজারের আস্থা জোরদার করেছে। যেমন, দেশে বর্ষার অগ্রগতি, তেলের দাম স্থিতিশীল থাকা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা — এই সমস্ত উপাদান বিনিয়োগকারীদের মনোবল বাড়িয়েছে।
রিলিগেয়ার ব্রোকিং-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (রিসার্চ) অজিত মিশ্র বলেছেন, “দেশীয় ফ্রন্টে বর্ষার অগ্রগতি, তেলের কম দাম এবং স্থিতিশীল ম্যাক্রো ইন্ডিকেটর বাজারে ইতিবাচক ধারা বজায় রেখেছে। একদিনে ১২,০০০ কোটি টাকার বেশি FII প্রবাহ বাজারে আত্মবিশ্বাস আরও শক্ত করেছে।”
ক্রমবর্ধমান বাজারে নতুন রেকর্ড
২০২৫ সালে সেনসেক্স এবং নিফটি উভয়ই নতুন রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক এবং দেশীয় দুই ধরনের সমর্থনই এই উত্থানকে সম্ভব করেছে।
বড় মূলধনী শেয়ারগুলিতে FII-র আগ্রহ এবং দেশীয় বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ, উভয়ের সমন্বয়ে বাজারে একটি দৃঢ় বুলিশ ধারা তৈরি হয়েছে। যদিও কিছু সেক্টরে বেশি দাম নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, তবে সামগ্রিক চিত্রে বাজারের শক্তি স্পষ্ট।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিচ্ছেন, এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা চিরকাল বজায় থাকবে না। বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন, মূল্যায়নের উচ্চতা এবং নীতিনির্ধারণী অনিশ্চয়তা ভবিষ্যতে কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে, দেশের আর্থিক নীতি, ক্রমবর্ধমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি এবং পুঁজির সরবরাহ — এই চারটি মিলে বাজারের ভিত্তি শক্ত করে তুলেছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা এখনো আশাবাদী।
ফলে বলা যায়, জুন মাসে ভারতের শেয়ারবাজারে FII-র ফেরার এই প্রবণতা শুধু বাজারকেই নয়, দেশের অর্থনৈতিক মর্যাদাকেও নতুন করে চাঙা করেছে। সামনের দিনগুলোতে এই ধারা বজায় থাকে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।