রবিবার সরকারের প্রকাশিত এক গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে যে, দেশের বেশিরভাগ কয়লা-চালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উপর সালফার নির্গমন নিয়ম শিথিল করা হয়েছে। এর ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ প্রতি ইউনিটে ২৫-৩০ পয়সা কমতে (Electricity Bills) পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তটি মূলত খরচ, জলবায়ু ও নিয়ম মেনে চলার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করতে নেওয়া হয়েছে।
২০১৫ সালে সরকার সমস্ত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিকে বাধ্যতামূলকভাবে ফ্লু-গ্যাস ডিজালফারাইজেশন (FGD) সিস্টেম বসানোর নির্দেশ দিয়েছিল, যা সালফার অক্সাইড নির্গমন কমাতে ব্যবহৃত হয়। তবে নতুন নিয়ম অনুযায়ী, শুধুমাত্র জনসংখ্যা এক মিলিয়নের বেশি এমন শহর থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা কেন্দ্রগুলির ক্ষেত্রে FGD বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
তবে যারা ‘ক্রিটিকালি পলিউটেড এরিয়া’ বা ‘নন-অ্যাটেইনমেন্ট সিটি’ (যেখানে বায়ু মান জাতীয় মানের চেয়ে খারাপ) অঞ্চলে রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পৃথকভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। অন্যদিকে, প্রায় ৭৯ শতাংশ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে এই বাধ্যবাধকতার বাইরে রাখা হয়েছে।
পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের বিশদ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকার জানিয়েছে, FGD ব্যবহারে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনও লক্ষ্য করা গিয়েছিল। কারণ FGD চালাতে বেশি শক্তি লাগে এবং লিমেস্টোন খনন ও পরিবহণ প্রক্রিয়ার ফলে অতিরিক্ত CO2 নির্গত হয়। ইন্ডাস্ট্রি সূত্রে জানা গেছে, এই নতুন নীতির ফলে কেন্দ্রগুলির অবস্থান ও কয়লার সালফার কন্টেন্টের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম কার্যকর হবে।
আইআইটি দিল্লি, CSIR-NEERI ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (NIAS)-এর একাধিক সমীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে বায়ুতে সালফার ডাই অক্সাইডের পরিমাণ জাতীয় বায়ু মান (NAAQS)-এর তুলনায় অনেক কম।
মাপজোখ অনুযায়ী, ভারতের বিভিন্ন শহরে সালফার অক্সাইডের গড় মান ৩ থেকে ২০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার, যেখানে NAAQS মান ৮০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার পর্যন্ত অনুমোদন করে।
NIAS-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশজুড়ে FGD বসানোর ফলে ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৬৯ মিলিয়ন টন অতিরিক্ত CO2 নির্গত হবে। এর মূল কারণ হিসাবে অতিরিক্ত লিমেস্টোন খনন, ট্রান্সপোর্টেশন ও FGD সিস্টেম চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া, ভারতে ব্যবহৃত কয়লার সালফার কন্টেন্ট কম — মাত্র ০.৫ শতাংশের নিচে। আবার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির চিমনির উচ্চতা বেশি এবং বায়ুর চলাচলের অনুকূল পরিস্থিতির কারণে সালফার ডাই অক্সাইড সহজেই ছড়িয়ে যায়। ফলে বায়ু দূষণের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম।
শিল্প মহল থেকে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়েছে। এক শীর্ষ সরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ বলেছেন, ‘‘এটি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। অপ্রয়োজনীয় খরচ এড়ানো এবং যেখানে প্রয়োজন, সেখানেই নিয়ম প্রয়োগ করার জন্য এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ইতিবাচক। এতে সাধারণ মানুষের বিদ্যুৎ বিলও সস্তা হবে।’’
প্রসঙ্গত, সব তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে FGD বসালে আনুমানিক খরচ হতো প্রায় ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রতি মেগাওয়াটে প্রায় ১.২ কোটি টাকা। এছাড়া প্রতিটি ইউনিটে ৪৫ দিন পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধ রাখতে হতো, যা বিদ্যুৎ সরবরাহে বড় প্রভাব ফেলতে পারত।
সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের চাহিদাভিত্তিক ও খরচ-সংবেদনশীল বাজারে এই সিদ্ধান্তের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ হবে। এতে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানিগুলি (ডিসকম) ট্যারিফ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে এবং সরকারের ওপর ভর্তুকির বোঝা কিছুটা কমবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘‘এটি কোনো নিয়ম বাতিল নয়, বরং বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে একটি পুনঃমূল্যায়ন। আমরা এখন আরও লক্ষ্যভিত্তিক, কার্যকর এবং জলবায়ুবান্ধব পদ্ধতি অনুসরণ করছি।’’
সরকার এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে শীঘ্রই সুপ্রিম কোর্টে (MC Mehta বনাম ভারত সরকার মামলায়) একটি হলফনামা দাখিল করবে। ওই মামলায় FGD বাস্তবায়নের সময়সীমা নিয়ে বিচারাধীন রয়েছে।
সর্বশেষে বলা যায়, সরকারের এই পদক্ষেপ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য যেমন স্বস্তির, তেমনি দেশের কোটি কোটি বিদ্যুৎ গ্রাহকের জন্যও স্বাগতযোগ্য। একদিকে দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য রক্ষিত হবে, অন্যদিকে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।