মিউচুয়াল ফান্ড জগতের ইতিহাসে অন্যতম বড় কেলেঙ্কারির অভিযোগে গ্রেপ্তার হলেন Viresh Joshi, যিনি ছিলেন অ্যাক্সিস মিউচুয়াল ফান্ডের প্রধান ট্রেডার এবং ফান্ড ম্যানেজার। তাঁকে শনিবার (৩ আগস্ট) গ্রেফতার করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ED) এবং রবিবার আদালতে পেশ করে তাকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত ED হেফাজতে পাঠানো হয়েছে।
এই মামলাটি মূলত ২ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রতারণাকে ঘিরে, যেখানে ‘ফ্রন্ট-রানিং’ নামক বেআইনি এবং অনৈতিক ট্রেডিং পদ্ধতির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অবৈধ লাভ করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
কী এই ‘ফ্রন্ট-রানিং’?
ফ্রন্ট-রানিং একটি গুরুতর শেয়ারবাজার সংক্রান্ত অপরাধ, যেখানে কোনো ট্রেডার বা ব্রোকার ক্লায়েন্টের অর্ডার সম্পর্কে আগাম তথ্য ব্যবহার করে নিজের পক্ষে লেনদেন করে। এতে করে বাজারে স্বচ্ছতা নষ্ট হয় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হন।
Viresh Joshi–র বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি অ্যাক্সিস মিউচুয়াল ফান্ডের পক্ষ থেকে করা হওয়া লেনদেন সংক্রান্ত গোপন তথ্য নিজের লাভের জন্য ব্যবহার করেছেন এবং এই পদ্ধতিতে অসৎ উপায়ে প্রচুর টাকা আয় করেছেন।
কোথা থেকে শুরু তদন্ত?
এই দুর্নীতির সূত্রপাত ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে, যখন Joshi অ্যাক্সিস মিউচুয়াল ফান্ডে কর্মরত ছিলেন। তিনি ওই সময়ে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ট্রেডিং প্ল্যান সম্পর্কে আগাম তথ্য জেনে তা নিজের এবং কিছু নির্দিষ্ট ব্রোকারদের মাধ্যমে শেয়ার মার্কেটে ব্যবহার করতেন বলে অভিযোগ।
২০২২ সালে প্রথম এই বিষয়ে আয়কর বিভাগ অনুসন্ধান চালায়। পরে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মুম্বই পুলিশের দায়ের করা একটি FIR-এর ভিত্তিতে ED পুরো ঘটনাটি নিয়ে অর্থপাচার প্রতিরোধ আইনের (PMLA) আওতায় তদন্ত শুরু করে।
কিভাবে চলত প্রতারণার ছক?
ED জানিয়েছে, Viresh Joshi দুবাই থেকে একটি ট্রেডিং টার্মিনাল ব্যবহার করতেন এবং বিভিন্ন ব্রোকারের মাধ্যমে ‘মিউল অ্যাকাউন্ট’ তৈরি করে শেয়ার কেনাবেচা করতেন। এই অ্যাকাউন্টগুলি আসলে বিভিন্ন লোকের নামে খোলা হলেও, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ ছিল Joshi এবং তাঁর সহযোগীদের হাতে।
এই জালিয়াতির মাধ্যমে Joshi ও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ ‘অবৈধ লাভ’ করে, যেগুলিকে পরে নানা শেল কোম্পানি ও ভুয়ো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সাদা করার চেষ্টা হয়। এখনও পর্যন্ত ED-এর মতে, অন্তত ২০০ কোটির অবৈধ অর্থ লেনদেন শনাক্ত হয়েছে, তবে এই অঙ্ক আরও অনেক বেশি হতে পারে বলেই সন্দেহ।
কোন কোন শহরে অভিযান?
ED ১ আগস্ট একযোগে দিল্লি, মুম্বই, গুরগাঁও, লুধিয়ানা, আহমেদাবাদ, ভুজ, ভাবনগর এবং কলকাতায় অভিযান চালায়। এই অভিযানে বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি, কম্পিউটার হার্ডডিস্ক, শেয়ার সার্টিফিকেট এবং ট্রানজাকশন ডেটা উদ্ধার হয়েছে।
এছাড়া, তদন্ত চলাকালীন Viresh Joshi ও তাঁর পরিবারের নামে থাকা ১৭.৪ কোটি টাকার সম্পত্তি, যার মধ্যে শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড ও ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স রয়েছে, তা ED দ্বারা অস্থায়ীভাবে জব্দ করা হয়েছে।
আরও কারা যুক্ত এই চক্রে?
শুধু Viresh Joshi নন, ED জানিয়েছে, আরও বেশ কয়েকজন ব্রোকার এবং ট্রেডার এই বেআইনি ফ্রন্ট-রানিং ট্রেডিং কর্মকাণ্ডে জড়িত। অনেকেই আগাম শেয়ার ক্রয়ের তথ্য পেয়ে মুনাফা করেছেন। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আলাদা করে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
তদন্তের ভিত্তিতে আরও গ্রেপ্তারির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে।
বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি ও উদ্বেগ:
অ্যাক্সিস মিউচুয়াল ফান্ড দেশের অন্যতম বৃহৎ মিউচুয়াল ফান্ড সংস্থা, যার অধীনে প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ পরিচালিত হয়। এত বড় একটি সংস্থার ট্রেডিং শাখার প্রধান যদি এইভাবে অনৈতিকভাবে বাজারে কারসাজি করে থাকেন, তাহলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
ভবিষ্যতে কী পদক্ষেপ?
ED ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা এখন পুরো সিস্টেমিক জালিয়াতির বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখছে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা পুনরাবৃত্তি না হয়। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (SEBI)–র পক্ষ থেকেও এই ধরনের ফ্রন্ট-রানিং প্রতিরোধে আরও কড়া নজরদারি ও নিয়ম আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখা কতটা জরুরি। সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ যাতে কোনওভাবেই প্রতারণার শিকার না হয়, তার জন্য এমন কড়া পদক্ষেপ সময়োচিত এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।