ভারতের ডাক বিভাগ রবিবার এক গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রগামী সমস্ত শ্রেণির ডাকসেবা আপাতত সম্পূর্ণভাবে স্থগিত করা হলো। এর ফলে চিঠি, নথি, পার্সেল কিংবা ১০০ মার্কিন ডলারের নিচে মূল্যের উপহার সামগ্রী—কোনোটিই আপাতত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডাকযোগে পাঠানো যাবে না।
এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ হচ্ছে মার্কিন প্রশাসনের নতুন এক্সিকিউটিভ অর্ডার (Executive Order No. 14324), যা গত ৩০ জুলাই জারি করা হয় এবং ২৯ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে। ওই আদেশ অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশ থেকে ডাকযোগে পাঠানো ৮০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত মূল্যের পণ্যের ওপর আর কোনো ডিউটি-ফ্রি ছাড় থাকবে না। আগে পর্যন্ত এই সীমার মধ্যে থাকা পণ্য করমুক্ত অবস্থায় আমদানি করা যেত। কিন্তু নতুন নিয়মে এখন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো সব আন্তর্জাতিক ডাকপণ্য, তার মূল্য যতই হোক না কেন, কাস্টমস শুল্কের আওতায় আসবে।
মার্কিন প্রশাসন “International Emergency Economic Power Act (IEEPA)”–এর আওতায় এই নীতি প্রবর্তন করেছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক ডাকপণ্য বহনকারী এয়ারলাইন বা পরিবহন সংস্থাগুলোকে এখন মার্কিন কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন (CBP)-এর অনুমোদিত “qualified party” হিসেবে শুল্ক আদায় ও জমা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হবে। কিন্তু CBP এখনও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ দিকনির্দেশনা দেয়নি। ফলে কার্যকরী ব্যবস্থার অভাবে এয়ার ক্যারিয়াররা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রগামী ডাকপণ্য বহন করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।
যদিও CBP ১৫ আগস্ট কিছু নির্দেশিকা জারি করেছিল, তবুও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন—কে “qualified party” হিসেবে দায়িত্ব নেবে, কীভাবে শুল্ক আদায় করা হবে, কীভাবে তা জমা দেওয়া হবে—এসবই অনির্ধারিত রয়ে গেছে। এই কারণে মার্কিনমুখী এয়ারলাইন কোম্পানিগুলো ২৫ আগস্ট থেকে ডাকপণ্য বহন বন্ধ করে দেয়। তাদের দাবি, পরিষ্কার নিয়ম না থাকায় প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে।
প্রথমে ডাক বিভাগ ২৫ আগস্ট থেকে সাময়িকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রগামী সব ধরনের ডাকসেবা স্থগিত করে। তবে তখনও ১০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত মূল্যের নথি ও উপহারসামগ্রী পাঠানোর অনুমতি ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠায় এবং ক্যারিয়ারদের অনীহার কারণে এখন সেসব বুকিংও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
রবিবার জারি করা নতুন বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং যত দ্রুত সম্ভব ডাকসেবা পুনরায় চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
একইসঙ্গে গ্রাহকদের জন্য একটি সান্ত্বনাও রাখা হয়েছে। যারা ইতিমধ্যেই ডাকযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর জন্য কোনো সামগ্রী বুকিং করেছেন, কিন্তু তা প্রেরণ করা সম্ভব হয়নি, তারা পোস্টেজ ফি ফেরতের আবেদন করতে পারবেন। ডাক বিভাগ জানিয়েছে, “গ্রাহকদের অসুবিধার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”
এই সিদ্ধান্তের ফলে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বেন প্রবাসী ভারতীয়দের পরিবার এবং ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকেরা। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিয়মিত প্রয়োজনীয় নথি, বইপত্র কিংবা ছোটখাটো উপহার পাঠানো হয়ে থাকে ডাকের মাধ্যমে। এখন তা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক পরিবারকে বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান করতে হবে।
এছাড়া, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা যারা ডাকযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পাঠান, তাদের জন্য এটি বড় ধাক্কা। আন্তর্জাতিক কুরিয়ার পরিষেবার মাধ্যমে কিছুটা সুযোগ থাকলেও খরচ অনেক বেশি হওয়ায় ছোট ব্যবসায়ীদের পক্ষে তা টেকসই হবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তকে অনেক বিশেষজ্ঞ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতির কড়াকড়ি হিসেবে দেখছেন। দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন প্রশাসন ডাকযোগে আসা বিদেশি পণ্যের ওপর বাড়তি নজরদারি চাইছিল। এশিয়ার একাধিক দেশ থেকে সস্তায় পণ্য প্রবেশ করায় মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছিল বলে তাদের দাবি।
ভারতীয় ডাক বিভাগ এখন মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সমস্যার সমাধান খুঁজছে। তবে যতদিন না পর্যন্ত শুল্ক আদায় ও জমা দেওয়ার নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া তৈরি হচ্ছে, ততদিন মার্কিনমুখী ডাকসেবা স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম।
ভারতীয় ডাক বিভাগের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের জন্য অসুবিধার। তবে অনিবার্য পরিস্থিতির কারণে আপাতত এটি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। ডাক বিভাগ আশ্বাস দিয়েছে যে, খুব শিগগিরই সমস্যার সমাধান খোঁজা হবে।
গ্রাহকদেরও আপাতত ধৈর্য ধরতে হবে এবং যাদের জরুরি প্রেরণের প্রয়োজন, তাদের আন্তর্জাতিক কুরিয়ার পরিষেবার মতো বিকল্প পথ বিবেচনা করতে হবে। তবে সরকারি ডাকসেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যয় বাড়বে এবং সাধারণ মানুষের নাগালে থাকা যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধাক্কা লাগবে।
সর্বোপরি বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি এবং তার ফলে তৈরি হওয়া প্রশাসনিক জটিলতা আন্তর্জাতিক ডাকসেবায় এক অচলাবস্থা তৈরি করেছে। ভারতের ডাক বিভাগ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে, তবে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব কেবল সময়ই বলে দেবে।