ভারতে চীনা-যুক্ত সাইবার প্রতারণা চক্রের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশের তদন্ত

দিল্লি পুলিশের (Delhi Police) সাইবার ইউনিট ও ইন্টেলিজেন্স ফিউশন অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক অপারেশন (IFSO) ইউনিট এক অভূতপূর্ব সাইবার অপরাধ চক্রের সন্ধান পেয়েছে, যেখানে ভারতীয় প্রতারকরা বিদেশি,…

Delhi Police Intensifies Probe into Chinese-Linked Cyber Fraud Syndicate Targeting India

দিল্লি পুলিশের (Delhi Police) সাইবার ইউনিট ও ইন্টেলিজেন্স ফিউশন অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক অপারেশন (IFSO) ইউনিট এক অভূতপূর্ব সাইবার অপরাধ চক্রের সন্ধান পেয়েছে, যেখানে ভারতীয় প্রতারকরা বিদেশি, বিশেষ করে চীনা নাগরিকদের সঙ্গে মিলে ডিজিটাল প্রতারণার কাজে লিপ্ত রয়েছে।

শুক্রবার পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দিল্লির অন্তত ১৫টি জেলার সাইবার থানাগুলি গত কয়েক মাসে বিভিন্ন সাইবার প্রতারণার মামলার তদন্ত করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছে যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধৃত অভিযুক্তরা চীনা হ্যান্ডলারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে ছিল।

   

এক তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, “আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এই চক্রে বিদেশি হ্যান্ডলাররা এনক্রিপ্টেড সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপের মাধ্যমে ভারতীয় সহযোগীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। তারা মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে স্থানীয় প্রতারকদের থেকে সিম কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও ডিজিটাল লেনদেনের অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করে।”

চীনা হ্যান্ডলারের নির্দেশে ভারতীয় প্রতারকদের সক্রিয়তা:
দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, এই চক্রে লিপ্ত ভারতীয় সদস্যরা চীনা হ্যান্ডলারদের নির্দেশে অনলাইনে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ইন্টারনেটে সহজ কাজের প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করা হয়, এরপর বিভিন্ন ভুয়া দাবি যেমন ‘অ্যাকাউন্ট আনফ্রিজ’, ‘ক্রেডিট স্কোর উন্নতি’ কিংবা ‘সরকারি কল্যাণ প্রকল্পে যোগদানের নাম করে’ অর্থ হাতানো হয়।

সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া তিনজন অভিযুক্ত—মহেন্দ্র সিং রাজাওয়াত (২৫), আরিফ খান (২৫) এবং লক্ষ্মী নারায়ণ বৈশ্য (২৩)—এই ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিম দিল্লির বহু মানুষকে ঠকিয়েছে বলে অভিযোগ। তারা অনলাইনে হোটেল বা রেস্তোরাঁর ইতিবাচক রিভিউ লেখার বিনিময়ে অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোকজনকে প্রলোভিত করত।

এক পুলিশ অফিসার জানান, “এই তিন অভিযুক্ত সরাসরি চীনা নাগরিকের সঙ্গে এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখত। তারা প্রতারিত অর্থকে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ঘুরিয়ে ইউএসডিটি (USDT) বা Tether ক্রিপ্টোকারেন্সিতে রূপান্তর করে চীনে পাঠাত।”

পাঞ্জাবে ধরা পড়ল আরেক চক্র, ব্যবহার হয়েছে নেপাল:
আরেকটি ঘটনায় পাঞ্জাবের দুই ব্যক্তি—পবন (২৯, চণ্ডীগড়) ও মনকিরাত (৩৬, ফিরোজপুর)—এক মহিলাকে অনলাইন ইনভেস্টমেন্ট স্ক্যামের মাধ্যমে ২১ লক্ষ টাকা প্রতারণা করে। তারা এ কাজে নেপাল সফরও করেছিল এবং তদন্তে জানা গেছে, চীনা হ্যান্ডলারদের নির্দেশেই তারা এই প্রতারণা করত।

পুলিশ জানায়, এসব প্রতারক চক্র সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রথমে টেলিগ্রাম বা হোয়াটসঅ্যাপের মতো এনক্রিপ্টেড চ্যাট অ্যাপে যোগাযোগ করে। পরে খুব সহজ কাজের প্রলোভন দেখিয়ে ছোট অঙ্কের টাকা পাঠিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে। এরপর ধাপে ধাপে প্রতারণার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

Advertisements

আন্তর্জাতিক চক্রের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করছে দিল্লি পুলিশ:
দিল্লি পুলিশের এক সিনিয়র অফিসার বলেন, “এই ধরনের আন্তর্জাতিক সমন্বয়ে পরিচালিত সাইবার অপরাধের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। আমরা এখন একটি সমন্বিত কৌশলের মাধ্যমে ভারতের মধ্যে অবস্থানরত এই চীনা হ্যান্ডলারদের খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছি।”

তিনি আরও জানান, শুধু দিল্লিতেই প্রতি মাসে ১৫টির বেশি এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা পুলিশ রেকর্ড করছে। ইতিমধ্যেই বহু অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে চীনা নাগরিকদের সঙ্গে যোগাযোগের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মিলেছে।

ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অর্থ পাচার:
এই চক্রের বড় অস্ত্র হল ক্রিপ্টোকারেন্সি। পুলিশ বলছে, প্রতারণা করে পাওয়া টাকা একাধিক ভুয়া ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়, এরপর তা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়। এই কাজে USDT-এর মতো ডিজিটাল কারেন্সি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।

সাইবার বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের অপরাধে এনক্রিপ্টেড অ্যাপ এবং ডিজিটাল কারেন্সি ব্যবহারের ফলে অপরাধীদের চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তবু দিল্লি পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি যৌথভাবে তদন্ত করে এই আন্তর্জাতিক চক্রের শিকড়ে পৌঁছাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

পুলিশি পরামর্শ: সতর্ক হোন, অচেনা অফারে সাড়া দেবেন না:
পুলিশ সাধারণ নাগরিকদের প্রতি অনুরোধ করেছে যে, তারা যেন ই-মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রামে প্রাপ্ত অচেনা বা অস্বাভাবিক অফারে সাড়া না দেন। অনলাইন কোনও কাজের বিনিময়ে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব সন্দেহজনক হলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ সাইবার থানায় যোগাযোগ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

দিল্লি পুলিশের এই অভিযান যে এক আন্তর্জাতিক প্রতারণা চক্রের জাল ভেদ করে চীনা হ্যান্ডলারদের মুখোশ উন্মোচনের পথে এগোচ্ছে, তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট। প্রশ্ন উঠছে—এই ধরনের প্রতারণা রুখতে কেন্দ্র বা রাজ্য প্রশাসন আরও কড়া নীতিমালা গ্রহণ করবে কি না, এবং চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক স্তরে এর কোনও প্রতিক্রিয়া হবে কি না।

পরবর্তী কিছু সপ্তাহে এই তদন্ত কতদূর এগোয় এবং চীনা হ্যান্ডলারদের কতটা চিহ্নিত করে ধরা যায়, সেদিকেই নজর থাকবে গোটা দেশের।