ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতিতে একটি বড় মাইলফলক ছুঁলো ইউনিফাইড পেমেন্টস ইন্টারফেস (UPI)। ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (NPCI)-র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ২ আগস্ট, ইউপিআই-ভিত্তিক দৈনিক লেনদেন প্রথমবারের মতো ৭০০ মিলিয়ন অতিক্রম করেছে। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, ওইদিন ৭০৭ মিলিয়ন লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে।
গত দুই বছরে এই পরিসংখ্যানে দ্বিগুণ বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। ২০২৩ সালের আগস্টে যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৩৫০ মিলিয়ন ইউপিআই লেনদেন হত, তা ২০২৪ সালের আগস্টে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০০ মিলিয়নে। আর এবারে সেটি ছুঁয়েছে ৭০০ মিলিয়নের নতুন শিখর।
২০২৬ সালের লক্ষ্য: দৈনিক ১০০ কোটির লেনদেন:
ভারত সরকার ইউপিআই-এর মাধ্যমে দৈনিক ১০০ কোটির (১ বিলিয়ন) লেনদেনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, এবং বর্তমান বৃদ্ধির হার বজায় থাকলে আগামী বছরই সেই লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। মাসিক ভিত্তিতে ইউপিআই লেনদেনে ৫ থেকে ৭ শতাংশ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে, যা বার্ষিক হিসেবে প্রায় ৪০ শতাংশ।
ব্যবসায়িক মডেল নিয়ে উদ্বেগ: MDR পুনরায় চালুর দাবি:
তবে এই সাফল্যের আড়ালে এক বড় প্রশ্ন উঠছে ইউপিআই-এর আর্থিক স্থায়িত্ব নিয়ে। বর্তমানে ইউপিআই ব্যবহারকারীদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পরিষেবা প্রদান করা হয়, যার খরচ বহন করে সরকার – ব্যাঙ্ক ও প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থাকে ভর্তুকি দিয়ে। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ইউপিআই-ভিত্তিক ভর্তুকির পরিমাণ ৪,৫০০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১,৫০০ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে, পেমেন্ট ইকোসিস্টেমের বিভিন্ন অংশগ্রহণকারী – যেমন ফিনটেক সংস্থা ও পেমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন – ইউপিআই পরিষেবাকে আর্থিকভাবে টেকসই করার জন্য “মার্চেন্ট ডিসকাউন্ট রেট” (MDR) পুনরায় চালুর দাবি জানিয়েছে। তাদের মত, বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য এবং উচ্চ-মূল্যের লেনদেনের ক্ষেত্রে সীমিত MDR ধার্য করা হলে, একদিকে ইউপিআই পরিকাঠামোর খরচ মেটানো যাবে, অন্যদিকে ১ বিলিয়ন লেনদেনের লক্ষ্যে পৌঁছনো আরও বাস্তবসম্মত হবে।
RBI-র সমর্থন: “খরচ কারও না কারও দিতে হবেই”:
এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (RBI) গভর্নর সঞ্জয় মালহোত্রার মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ইউপিআই পরিকাঠামোকে আর্থিকভাবে টেকসই করতে হবে এবং তার জন্য খরচের ভার বহন করতে হবে। “কোথাও না কোথাও খরচ হবে – সেটা কে বহন করবে, সেটা ভাবতে হবে,” বলেন মালহোত্রা।
বর্তমান MDR অবস্থা: ২০১৯-এ ছাড়, এখন কী হবে?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভারত সরকার RuPay ডেবিট কার্ড এবং BHIM-UPI ট্রানজ্যাকশনের উপর MDR সম্পূর্ণ মাফ করে দেয়। অর্থাৎ মার্চেন্টদের কাছ থেকে লেনদেনের জন্য কোনও চার্জ নেওয়া হয় না, যা ছোট ব্যবসার জন্য সহায়ক হলেও বৃহৎ পরিকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা তৈরি করছে।
বর্তমানে MDR চালু হবে কি না, বা ব্যবহারকারীরাও কি এই খরচের অংশীদার হবেন, সে বিষয়ে সরকারের তরফে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়নি।
বিশ্বে ইউপিআই-এর দাপট: Visa-কেও ছাড়িয়ে গেল ভারতীয় পদ্ধতি:
এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে রিয়েল-টাইম ডিজিটাল পেমেন্টের ক্ষেত্রে ভারতের ইউপিআই অন্যতম প্রধান প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি এটি দৈনিক ট্রানজাকশনের সংখ্যায় Visa-কে ছাড়িয়ে গেছে। জুলাই মাসে ইউপিআই-র মাধ্যমে প্রায় ১৯.৫ বিলিয়ন লেনদেন হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য ছাড়িয়েছে ২৫ লক্ষ কোটি টাকা। এই হিসেব অনুযায়ী, ইউপিআই প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন ট্রানজ্যাকশন পরিচালনা করেছে, যার আর্থিক মূল্য ছিল প্রায় ৮৩,০০০ কোটি টাকা।
বর্তমানে ভারতে হওয়া সমস্ত ডিজিটাল লেনদেনের প্রায় ৮৫ শতাংশই ইউপিআই মাধ্যমে হয়, এবং গোটা বিশ্বের রিয়েল-টাইম ডিজিটাল পেমেন্টের প্রায় ৫০ শতাংশ ইউপিআই দ্বারা পরিচালিত।
ইউপিআই নিঃসন্দেহে ভারতের ডিজিটাল রূপান্তরের একটি সাফল্যগাথা। তবে এখন প্রশ্ন উঠছে, এই অতি দ্রুত সম্প্রসারণ এবং ব্যাপক ব্যবহার কীভাবে দীর্ঘমেয়াদে আর্থিকভাবে বজায় রাখা যাবে। প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো, সাইবার নিরাপত্তা, এবং সার্ভার রক্ষণাবেক্ষণের মতো বিষয়গুলির জন্য বড় অঙ্কের বিনিয়োগ দরকার।
তাই আগামী দিনে ইউপিআই-এর উন্নয়নের পাশাপাশি তার আর্থিক স্থায়িত্ব ও ব্যবস্থাপনার রূপরেখা কী হবে – সেটাই নজর রাখার বিষয়। সরকারের ভূমিকা, RBI-র দৃষ্টিভঙ্গি এবং ফিনটেক সংস্থাগুলির মতামত – সব মিলিয়ে এই বিতর্ক আগামী দিনে আরও গুরুত্ব পাবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।