ডাবরের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর জুস বিজ্ঞাপন অভিযোগ করল FSSAI

ভারতের শীর্ষস্থানীয় এফএমসিজি কোম্জল ডাবর ইন্ডিয়ার ‘রিয়েল’ ব্র্যান্ডের ফলের পানীয়কে ‘১০০ শতাংশ ফ্রুট জুস’ হিসেবে দাবি করার বিষয়টি ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ…

Dabur 100 Fruit Juice

ভারতের শীর্ষস্থানীয় এফএমসিজি কোম্জল ডাবর ইন্ডিয়ার ‘রিয়েল’ ব্র্যান্ডের ফলের পানীয়কে ‘১০০ শতাংশ ফ্রুট জুস’ হিসেবে দাবি করার বিষয়টি ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (FSSAI) দিল্লি হাইকোর্টে বিভ্রান্তিকর এবং আইনের লঙ্ঘনকারী বলে অভিযোগ করেছে। এফএসএসএআই-এর সহকারী পরিচালক স্মিতা সিংয়ের দায়ের করা একটি রিট পিটিশনে বলা হয়েছে, ডাবরের এই দাবি খাদ্য নিরাপত্তা ও মানদণ্ড আইন, ২০০৬ এবং এর অধীনে প্রণীত বিধি-বিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এই বিষয়ে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা চলমান রয়েছে, এবং পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারিত হয়েছে আগামী ৭ জুলাই, ২০২৫।

এফএসএসএআই-এর অভিযোগ
এফএসএসএআই-এর পিটিশনে বলা হয়েছে, ডাবরের ‘রিয়েল’ ফ্রুট জুস পণ্যগুলির লেবেলে ‘১০০ শতাংশ ফ্রুট জুস’ দাবি করা হলেও এই পানীয়গুলিতে জল এবং ফলের ঘনীভূত রস (কনসেনট্রেট) ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, মিক্সড ফ্রুট জুসে ফলের ঘনীভূত রসের পরিমাণ মাত্র ৬.৮ শতাংশ, এবং এতে প্রাকৃতিক স্বাদযুক্ত পদার্থও যোগ করা হয়। এফএসএসএআই-এর বৈজ্ঞানিক প্যানেল (এসপি-০৮) তাদের ৪৭তম এবং ৪৯তম বৈঠকে এই দাবিকে বিভ্রান্তিকর বলে উল্লেখ করেছে। প্যানেলের মতে, এই ধরনের লেবেলিং ভোক্তাদের মনে ভুল ধারণা তৈরি করে এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও মানদণ্ড (বিজ্ঞাপন ও দাবি) বিধিমালা, ২০১৮-এর শিডিউল V-এর লঙ্ঘন।

   

এফএসএসএআই আরও জানিয়েছে, ‘১০০ শতাংশ’ শব্দটি খাদ্য পণ্যের জন্য কোনও সংজ্ঞায়িত বা স্বীকৃত পদ নয়। এটি একটি সংখ্যাগত পরিমাণ নির্দেশক (নিউমেরিক্যাল কোয়ান্টিফায়ার), যা পণ্যের গুণগত বর্ণনার পরিবর্তে ভোক্তাদের বিভ্রান্ত করে। পিটিশনে বলা হয়েছে, “যে কোনও খাদ্য ব্যবসা পরিচালনকারী (এফবিও) ‘১০০ শতাংশ’ শব্দটি ব্যবহার করে ফ্রুট জুসের লেবেলিং, বিজ্ঞাপন বা বিপণন করলে তা কোনও আইনি অনুমোদন ছাড়াই এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও মানদণ্ড আইন, ২০০৬-এর অধীনে নির্ধারিত নিয়ন্ত্রক কাঠামোর স্পষ্ট লঙ্ঘন হবে।”

এফএসএসএআই-এর নির্দেশনা
২০২৪ সালের জুন মাসে এফএসএসএআই একটি নির্দেশনা জারি করে সমস্ত খাদ্য ব্যবসা পরিচালনকারীদের ফ্রুট জুসের লেবেল এবং বিজ্ঞাপন থেকে ‘১০০ শতাংশ ফ্রুট জুস’ দাবি অপসারণ করতে বলে। এই নির্দেশনা অনুসারে, পুনর্গঠিত (রিকনস্টিটিউটেড) ফ্রুট জুসের ক্ষেত্রে এই দাবি বিভ্রান্তিকর, কারণ এই পানীয়গুলির প্রধান উপাদান হল জল এবং ফলের ঘনীভূত রসের পরিমাণ সীমিত। এফএসএসএআই-এর নির্বাহী পরিচালক (নিয়ন্ত্রক সম্মতি) ইনোশি শর্মা বলেন, “এই ধরনের দাবি ভোক্তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং সত্য প্রকাশের নীতির পরিপন্থী।” তিনি আরও জানান, কিছু নির্মাতা ডি-আয়নাইজড অ্যাপল জুস কনসেনট্রেটের মতো অ-মানক উপাদান ব্যবহার করছে, যা স্থানীয় বিধি অনুযায়ী অনুমোদিত নয়।

ডাবরের যুক্তি
ডাবর তাদের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছে, তাদের ‘রিয়েল অ্যাকটিভ’ জুসের মতো পুনর্গঠিত পণ্যগুলি ফলের ঘনীভূত রসে জল যোগ করে তৈরি করা হয়, যা ফলের প্রাকৃতিক গঠন পুনরুদ্ধার করে। এই প্রক্রিয়ায় কোনও অতিরিক্ত চিনি যোগ করা হয় না এবং এটি এফএসএসএআই-এর মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ডাবরের দাবি, তাদের ‘১০০ শতাংশ ফ্রুট জুস’ লেবেলিং এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তারা এফএসএসএআই-এর নির্দেশনাকে আইনগতভাবে অযৌক্তিক এবং বিদ্যমান বিধিবিধানের ভুল ব্যাখ্যার ফল বলে দাবি করেছে। ২০২৫ সালের মার্চে ডাবর এই নির্দেশনার বিরুদ্ধে দিল্লি হাইকোর্টে একটি পিটিশন দায়ের করে। তবে, ২ এপ্রিলের শুনানিতে বিচারপতি সচিন দত্তা কোনও অন্তর্বর্তীকালীন স্বস্তি প্রদান করেননি, যদিও তিনি মামলাটি বিস্তারিতভাবে শুনানির জন্য নির্ধারণ করেন।

আইনি অবস্থান ও ভোক্তা স্বার্থ
কেন্দ্রীয় সরকার, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং এফএসএসএআই-এর যৌথ হলফনামায় বলা হয়েছে, ‘১০০ শতাংশ’ দাবি ভোক্তাদের প্রতারণা করে এবং তাদের আস্থা ক্ষুণ্ণ করে। এই হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে, খাদ্য নিরাপত্তা ও মানদণ্ড (বিজ্ঞাপন ও দাবি) বিধিমালা, ২০১৮-এর অধীনে এই ধরনের সংখ্যাগত দাবি অনুমোদিত নয়। এফএসএসএআই-এর আইনি প্রতিনিধি প্রেমতোষ কুমার মিশ্র আদালতে বলেন, “এই দাবির কোনও সংবিধিবদ্ধ স্বীকৃতি নেই। ডাবরের এই লেবেলিং চালিয়ে যাওয়ার কোনও অধিকার নেই।” এফএসএসএআই আরও জানায়, এই ধরনের লেবেলিং ভোক্তাদের মনে পণ্যের গঠন সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করে, বিশেষত যখন পণ্যে জল বা অন্যান্য উপাদান যোগ করা হয়।

এফএসএসএআই-এর পূর্ববর্তী পদক্ষেপ
এটি প্রথম নয় যে এফএসএসএআই বিভ্রান্তিকর লেবেলিংয়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে। এর আগে ২০২৪ সালের মার্চে এফএসএসএআই দুগ্ধ-ভিত্তিক পানীয় মিশ্রণ এবং মল্ট-ভিত্তিক পানীয় নির্মাতাদের ‘হেলথ ড্রিঙ্ক’ বা ‘এনার্জি ড্রিঙ্ক’ হিসেবে বিপণন বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়। এফএসএসএআই-এর নিয়ন্ত্রক সম্মতি বিভাগের পরিচালক রাকেশ কুমার বলেন, “এই ধরনের পদক্ষেপ পণ্যের প্রকৃতি ও কার্যকারিতা সম্পর্কে স্বচ্ছতা বাড়ায় এবং ভোক্তাদের সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে পছন্দ করতে সহায়তা করে।”

ডাবরের পূর্ববর্তী বিতর্ক
ডাবরের ‘রিয়েল’ ফ্রুট জুস নিয়ে এর আগেও বিতর্ক হয়েছে। ২০২৩ সালে জনপ্রিয় ইউটিউবার ধ্রুব রাঠি তাঁর একটি ভিডিওতে ‘রিয়েল’ জুসের স্বাস্থ্যগত প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুললে ডাবর কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে। আদালত ধ্রুব রাঠিকে ভিডিও থেকে ‘রিয়েল’ জুসের উল্লেখ অপসারণের নির্দেশ দেয়। এই ঘটনা ডাবরের পণ্য বিপণন কৌশল নিয়ে বিতর্কের জন্ম দেয়।

ডাবরের ‘১০০ শতাংশ ফ্রুট জুস’ দাবি নিয়ে এফএসএসএআই-এর সঙ্গে আইনি লড়াই ভোক্তা স্বার্থ এবং খাদ্য লেবেলিংয়ের স্বচ্ছতার বিষয়টিকে সামনে এনেছে। এফএসএসএআই-এর অভিযোগ, এই দাবি ভোক্তাদের বিভ্রান্ত করে এবং আইনের লঙ্ঘন করে। অন্যদিকে, ডাবর তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ার বৈধতার দাবি করছে। দিল্লি হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায় এই বিতর্কের নিষ্পত্তি করবে এবং ভবিষ্যতে খাদ্য পণ্যের লেবেলিং নিয়ে নতুন নজির স্থাপন করতে পারে। এই মামলার ফলাফল ভোক্তাদের সঠিক তথ্য প্রাপ্তির অধিকার এবং খাদ্য শিল্পের বিপণন কৌশলের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।