অয়ন দে, কোচবিহার: কোচবিহারের কৃষি জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন নার্সারি ব্যবসায়ী স্বপন কুমার দে। তাঁর ‘দে নার্সারি’ এখন উত্তরবঙ্গের কৃষকদের কাছে একটি আলোচিত নাম। বিশেষ করে বিদেশি আমের (Miyazaki Mango) চাষে তিনি যে সাফল্য অর্জন করেছেন, তা কৃষক সম্প্রদায়ের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। মাত্র দুই বছর আগে তিনি তাঁর নার্সারিতে প্রায় হাজার খানেক আমের চারা বিক্রির জন্য এনেছিলেন, যার মধ্যে ৩০ শতাংশ ছিল বিদেশি জাতের এবং ৭০ শতাংশ দেশি জাতের। সব চারা বিক্রি হয়ে গেলেও, তিনি কয়েকটি উন্নতমানের বিদেশি আমের চারা নিজের বাড়িতে রোপণ করেছিলেন। এর মধ্যে একটি হল বিশ্বের সবচেয়ে দামি আম হিসেবে পরিচিত মিয়াজাকি আম, যার দাম লাখ টাকারও বেশি। স্বপনবাবুর এই উদ্যোগ এবং সাফল্য কৃষি জগতে এক নতুন পথ দেখাচ্ছে।
উত্তরবঙ্গে আম চাষের চ্যালেঞ্জ
উত্তরবঙ্গের মাটি ও আবহাওয়া আম চাষের জন্য সবসময়ই প্রতিকূল বলে বিবেচিত হয়েছে। কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিংয়ের মতো জেলাগুলোতে দেশি আমের চাষে অনেক কৃষক ব্যর্থ হয়েছেন। স্বপন কুমার দে জানান, উত্তরবঙ্গের আবহাওয়া এবং মাটির গুণাগুণ দেশি আমের চাষের জন্য উপযুক্ত নয়। অতিরিক্ত আর্দ্রতা, ঠান্ডা আবহাওয়া এবং মাটির অম্লত্ব আমের গাছের ফলন এবং গুণগত মানের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এছাড়া, দেশি আমের গাছ রোগ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজতে গিয়ে স্বপনবাবু বিদেশি জাতের আমের চারা নিয়ে পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত এখন ফল দিচ্ছে।
বিদেশি আমের চাষে সাফল্য
স্বপন কুমার দে তাঁর নার্সারিতে থাইল্যান্ড, জাপান এবং অন্যান্য দেশ থেকে আমের চারা আমদানি করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল মিয়াজাকি আম, যা ‘লাল আম’ বা ‘সূর্যের ডিম’ নামে আন্তর্জাতিক বাজারে বিখ্যাত। এই আমের ওজন প্রায় ৩৫০ গ্রাম এবং এর রঙ বেগুনি। এর স্বাদ, সুগন্ধ এবং গুণগত মান এটিকে বিশ্বের শীর্ষ আমের তালিকায় স্থান করে দিয়েছে। স্বপনবাবু জানান, মিয়াজাকি আমের একটি ফলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে লাখ টাকারও বেশি হতে পারে। তিনি নিজের বাড়িতে এই আমের গাছ রোপণ করেছেন এবং ফলন পেয়ে অত্যন্ত খুশি।
তিনি আরও বলেন, বিদেশি জাতের আমের চাষে রোগ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ অনেকটাই কম। উত্তরবঙ্গের মাটিতে এই আমগুলো ভালো ফলন দিচ্ছে। বিশেষ করে থাইল্যান্ড থেকে আনা জাতগুলো, যেমন নাম ডক মাই, চুকানন এবং থাই কাঁচামিঠা, এই অঞ্চলের জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এই আমগুলো কাঁচা এবং পাকা উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়, যা বাজারে ব্যাপক চাহিদা তৈরি করেছে।
আর্থিক লাভের সম্ভাবনা
দেশি আমের চারার দাম যেখানে ২৫০-৩০০ টাকা, সেখানে বিদেশি আমের চারা, বিশেষ করে থাইল্যান্ডের চারার দাম ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ টাকা। এই উচ্চ দাম সত্ত্বেও, স্বপনবাবুর নার্সারিতে চারার চাহিদা ছিল প্রচুর। তিনি জানান, বিদেশি আমের চাষে প্রাথমিক বিনিয়োগ বেশি হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর লাভ অনেক বেশি। মিয়াজাকি আমের মতো জাতের ফল বাজারে বিক্রি করলে কৃষকরা লাখ টাকার লাভ করতে পারেন। তিনি কৃষকদের উদ্দেশে বলেন, “উত্তরবঙ্গের মাটিতে দেশি আমের চাষের পরিবর্তে বিদেশি জাতের আম চাষ করলে কৃষকরা বেশি লাভবান হবেন। এই জাতগুলোর ফলন ভালো এবং বাজারে এদের চাহিদা প্রচুর।”
কৃষি পদ্ধতি ও পরামর্শ
স্বপনবাবু জানান, বিদেশি আমের চাষে সফলতা পেতে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করা জরুরি। তিনি থাইল্যান্ডের নাম ডক মাই জাতের চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন, চারা রোপণের জন্য ৪ থেকে ৬ মিটার দূরত্ব রাখতে হয়। হেক্টরপ্রতি ১৮৫ থেকে ২৭৮টি চারা লাগানো যায়। চারা তৈরির জন্য পাকা ফল থেকে আঁটি সংগ্রহ করে বীজতলায় রোপণ করতে হয়। জ্যৈষ্ঠ থেকে আষাঢ় মাস এই কাজের জন্য উপযুক্ত। তিনি আরও পরামর্শ দেন, গাছের যত্নে পর্যাপ্ত সার এবং কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে গাছগুলো দ্রুত ফল দিতে শুরু করে।
উত্তরবঙ্গে কৃষির নতুন সম্ভাবনা
স্বপন কুমার দের এই উদ্যোগ উত্তরবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার পথ দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, “আমি চাই কৃষকরা ঐতিহ্যবাহী চাষের বাইরে গিয়ে নতুন জাতের ফসল চাষে আগ্রহী হোক। বিদেশি আমের চাষ শুধু লাভজনকই নয়, এটি আমাদের অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারে।” তাঁর নার্সারি এখন অনেক কৃষকের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে।
সমাজে প্রভাব
স্বপনবাবুর সাফল্য শুধু তাঁর ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটি কোচবিহারের কৃষক সম্প্রদায়ের জন্য একটি পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছে। তাঁর নার্সারি থেকে চারা কিনে অনেক কৃষক বিদেশি আমের চাষ শুরু করেছেন। এই চাষ বাণিজ্যিকভাবে সফল হলে উত্তরবঙ্গের কৃষি অর্থনীতি নতুন মাত্রা পাবে। তাছাড়া, মিয়াজাকি আমের মতো দামি ফসলের চাষ স্থানীয় বাজারে নতুন চাহিদা তৈরি করছে, যা কৃষকদের আয় বাড়াতে সাহায্য করবে।
স্বপন কুমার দের দে নার্সারি এখন উত্তরবঙ্গে কৃষি উদ্ভাবনের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। বিদেশি আমের চাষে তাঁর সাফল্য, বিশেষ করে মিয়াজাকি আমের ফলন, প্রমাণ করে যে সঠিক পরিকল্পনা এবং উদ্যোগের মাধ্যমে প্রতিকূল পরিবেশেও লাভজনক কৃষি সম্ভব। তাঁর এই প্রচেষ্টা কৃষকদের মধ্যে নতুন আশা জাগিয়েছে এবং উত্তরবঙ্গের কৃষি খাতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কৃষকদের প্রতি তাঁর পরামর্শ—বিদেশি জাতের আমের চাষে মনোযোগ দিন, কারণ এটি শুধু লাভজনকই নয়, বরং কৃষির ভবিষ্যৎ গড়তেও সাহায্য করবে।