কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামোর পর্যালোচনা ও সংশোধনের জন্য প্রতি দশ বছর অন্তর গঠিত হয় বেতন কমিশন। ২০১৬ সালে কার্যকর হওয়া ৭ম বেতন কমিশনের (7th Pay Commission) মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে, এবং ২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ৮ম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) গঠনের অনুমোদন দিয়েছে। এই কমিশন ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ঘোষণা প্রায় ৫০ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং ৬৫ লক্ষ পেনশনভোগীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। তবে, ৭ম এবং প্রত্যাশিত ৮ম বেতন কমিশনের মধ্যে বেতন গ্রেড, ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর এবং সুবিধার তুলনা কীভাবে দাঁড়ায়? এই প্রতিবেদনে আমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
৭ম বেতন কমিশন: একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ
৭ম বেতন কমিশন ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়, যা বিচারপতি অশোক কুমার মাথুরের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল। এই কমিশন পূর্ববর্তী ৬ষ্ঠ বেতন কমিশনের পে ব্যান্ড এবং গ্রেড পে সিস্টেম বাতিল করে একটি নতুন পে ম্যাট্রিক্স চালু করে। এই পে ম্যাট্রিক্সে ১৮টি স্তর (লেভেল) এবং ৪০টি ধাপ রয়েছে, যা বেতন কাঠামোকে আরও স্বচ্ছ ও সরল করেছে। ৭ম বেতন কমিশনের অধীনে ন্যূনতম মূল বেতন ৭,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮,০০০ টাকা করা হয়, যা প্রায় ১৫৭% বৃদ্ধি। ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর নির্ধারণ করা হয় ২.৫৭, যার মাধ্যমে পূর্ববর্তী বেতনকে গুণ করে নতুন বেতন নির্ধারণ করা হয়। এই কমিশনের ফলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন, ভাতা এবং পেনশন মিলিয়ে গড়ে ২৩.৫% বৃদ্ধি পায়।
মূল বেতন ছাড়াও, মহার্ঘ ভাতা (ডিএ), গৃহভাড়া ভাতা (এইচআরএ) এবং পরিবহন ভাতা (টিএ) এর মতো ভাতাগুলোর সংশোধন করা হয়। ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত ডিএ বেতনের ৫৫% এ পৌঁছেছে, যা মূল্যস্ফীতির প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক। এইচআরএ শহরের শ্রেণিবিভাগের উপর নির্ভর করে ২৭%, ১৮% এবং ৯% নির্ধারণ করা হয়। পেনশনভোগীদের জন্য ন্যূনতম পেনশন ৩,৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯,০০০ টাকা করা হয়, এবং গ্র্যাচুইটির সীমা ১০ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ লক্ষ টাকা করা হয়। এছাড়া, স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প এবং সিজিএইচএস-এর বাইরে নগদহীন চিকিৎসা সুবিধা চালু করা হয়।
৮ম বেতন কমিশন: প্রত্যাশিত পরিবর্তন
৮ম বেতন কমিশনের ঘোষণা সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। এই কমিশন ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৮ম বেতন কমিশনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.২৮ থেকে ২.৮৬ এর মধ্যে হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা ২.৮৬ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টরের, যা বেতন এবং পেনশনে ২৫-৩০% বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। এই ফিটমেন্ট ফ্যাক্টরের ভিত্তিতে, লেভেল ১-এ ন্যূনতম মূল বেতন ১৮,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ৪১,০০০ থেকে ৫১,৪৮০ টাকা হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, লেভেল ১-এর কর্মচারী (যেমন পিয়ন, অ্যাটেনডেন্ট) বর্তমানে ১৮,০০০ টাকা মূল বেতন পান, যা ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হলে ৫১,৪৮০ টাকায় উন্নীত হবে। লেভেল ৪-এর জুনিয়র ক্লার্ক বা স্টেনোগ্রাফারদের বেতন ২৫,৫০০ টাকা থেকে ৭২,৯৩০ টাকায়, এবং লেভেল ৭-এর সেকশন অফিসার বা অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারদের বেতন ৪৪,৯০০ টাকা থেকে ১,২৮,৪১৪ টাকায় বৃদ্ধি পেতে পারে। এই বৃদ্ধি ডিএ, এইচআরএ এবং অন্যান্য ভাতার সঙ্গে মিলে মোট বেতনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে।
৭ম বনাম ৮ম বেতন কমিশন: মূল পার্থক্য
৭ম বেতন কমিশন পে ব্যান্ড এবং গ্রেড পে সিস্টেমকে পে ম্যাট্রিক্স দিয়ে প্রতিস্থাপন করে বেতন কাঠামোকে আরও সরল করেছিল। এই ম্যাট্রিক্সে ১৮টি স্তর এবং ৪০টি ধাপ রয়েছে, যা প্রতি বছর ৩% বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মচারীদের বেতন প্রগতি নিশ্চিত করে। ৮ম বেতন কমিশন সম্ভবত এই পে ম্যাট্রিক্স কাঠামোই বজায় রাখবে, তবে নতুন ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভিত্তিতে বেতন স্তরগুলো সংশোধন করা হবে।
৬ষ্ঠ বেতন কমিশনের তুলনায় ৭ম কমিশনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর (২.৫৭) বেশি ছিল, যেখানে ৬ষ্ঠ কমিশনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ছিল ১.৮৬। এই ফ্যাক্টরের ফলে ৬ষ্ঠ কমিশনে বেতন ৪০% এবং ৭ম কমিশনে ২৩-২৫% বৃদ্ধি পেয়েছিল। ৮ম কমিশনে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হলে বেতন বৃদ্ধি ২৫-৩০% হতে পারে। এছাড়া, কর্মচারী সংগঠনগুলো ৩.০ থেকে ৩.৫ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টরের দাবি জানিয়েছে, যা ন্যূনতম বেতন ২৫,০০০-২৬,০০০ টাকায় উন্নীত করতে পারে।
পেনশনের ক্ষেত্রে, ৮ম কমিশন ন্যূনতম পেনশন ৯,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রায় ২০,৫০০ টাকা করতে পারে, যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.২৮ হয়। ২.৮৬ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর হলে এটি আরও বাড়তে পারে। গ্র্যাচুইটির সীমাও বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে, যা পেনশনভোগীদের জন্য অতিরিক্ত আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করবে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
৮ম বেতন কমিশনের বেতন বৃদ্ধি সরকারি কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে এবং অর্থনীতিতে ভোগ ব্যয় বাড়াবে। প্রধানমন্ত্রী মোদি এক্স-এ বলেছেন, “৮ম বেতন কমিশন সরকারি কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে এবং ভোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিকে গতিশীল করবে।” তবে, এই বৃদ্ধি সরকারের আর্থিক বোঝা বাড়াতে পারে, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে।
কর্মচারী সংগঠনগুলোর দাবির মধ্যে রয়েছে ন্যূনতম পাঁচটি পদোন্নতি, মহার্ঘ ভাতার নিয়মিত সংশোধন, এবং পুরনো পেনশন স্কিম (ওপিএস) পুনর্বহাল। এই দাবিগুলো ৮ম কমিশনের সুপারিশের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, চূড়ান্ত সুপারিশ অর্থনৈতিক অবস্থা, মূল্যস্ফীতি এবং সরকারি নীতির উপর নির্ভর করবে।
৭ম বেতন কমিশন সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল, এবং ৮ম বেতন কমিশন এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আরও উন্নত বেতন ও সুবিধা প্রদানের সম্ভাবনা রাখে। ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর, পে ম্যাট্রিক্স এবং ভাতার সংশোধনের মাধ্যমে এই কমিশন কর্মচারীদের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। তবে, চূড়ান্ত ফলাফল নির্ভর করবে কমিশনের সুপারিশ এবং সরকারের সিদ্ধান্তের উপর। সরকারি কর্মচারী এবং পেনশনভোগীরা এখন এই কমিশনের সুপারিশের অপেক্ষায় রয়েছেন, যা তাদের জীবনযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।