আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুনিয়ায় একটি বড় ঘটনা ঘটেছে। চিন তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী ও “আইরন ব্রাদার” বলে পরিচিত পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ রেল প্রকল্পের ফান্ডিং থেকে হঠাৎ পিছু হটেছে। চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (CPEC Rail Project) এর অংশ হিসেবে কারাচি থেকে রোহরি পর্যন্ত ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের রেল উন্নয়ন প্রকল্পটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এই সিদ্ধান্ত চিনের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের কাছে একটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা যাচ্ছে, যা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক স্থিতিশীলতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
চিনের পিছু হটার কারণ কী?
সূত্রের মতে, চিনের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের পেছনে পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান বাহ্যিক ঋণ ও ভ্রষ্টাচারের অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, পাকিস্তানের বাহ্যিক ঋণ ২০২৪ সালের শেষে ১৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। চিন, যিনি সিপেকের মাধ্যমে পাকিস্তানে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছিলেন, এখন বুঝতে পেরেছেন যে তাদের অর্থ পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের হাতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভ্রষ্টাচার ও অপরিচয়িত ব্যবহারের অভিযোগে চিন সতর্ক হয়ে উঠেছে এবং তাই তিনি এই প্রকল্প থেকে হাত সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
এর সঙ্গে পারিবারিক উদ্বেগও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ২০২৩ সালে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইএপি) এর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পাকিস্তানে প্রায় ৫,০০০ গ্লেসিয়ার ক্রমশ গলছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের একটি সরাসরি ফল। সিপেকের অধীনে যে কয়েকটি কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা পরিবেশবাদীদের তীব্র সমালোচনার মুখে রয়েছে। চিন, যিনি সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ করছেন, এই প্রকল্পগুলোর কারণে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে পারেন, যা তাদের পিছু হটার একটি কারণ হতে পারে।
এডিবি-এর প্রবেশ
চিনের এই পদক্ষেপের ফলে পাকিস্তানের জন্য একটি বিকল্প পথ খোলা হয়েছে। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এখন এই ২ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের জন্য ফান্ডিং দেবার প্রস্তাব দিয়েছে। ১৯৬৬ সাল থেকে পাকিস্তানে ৫২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা রাখা এডিবি, এই ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেল লাইনের আধুনিকীকরণে সহায়তা করবে। এই প্রকল্পটি কারাচি থেকে রোহরি পর্যন্ত রেল পথ উন্নত করবে, যা রেকো ডিক খনি থেকে তামার পণ্য পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এডিবি-এর এই পদক্ষেপ চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের প্রভাব কমিয়ে আনতে পারে এবং পাকিস্তানের জন্য একটি বেশি টেকসই বিনিয়োগ মডেল প্রদান করবে।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
চিনের প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসা পাকিস্তানের জন্য একটি বড় ধাক্কা। সিপেক ছিল পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের একটি মূল ভিত্তি, যা দেশের পড়তা অবকাঠামো উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এখন এই প্রকল্পের বাতিল হওয়া পাকিস্তানের রেল পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করবে এবং রেকো ডিক খনির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর সময়সূচীতে বিলম্ব ঘটতে পারে। এছাড়া, পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর চাপ বাড়বে, কারণ তাদের চিনের সঙ্গে সম্পর্ক সংশোধন করতে হবে এবং এডিবি-সহ নতুন বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে হবে।
ভারতের দৃষ্টিকোণ
ভারত এই ঘটনাকে নিজের জন্য একটি সুযোগ হিসেবে দেখছে। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর (পিওকে) জুড়ে সিপেকের প্রকল্প ভারতের জন্য সবসময় একটি উদ্বেগের বিষয় ছিল। চিনের পিছু হওয়া এবং এডিবি-এর প্রবেশ ভারতের জন্য পিওকে-তে তার ভৌগোলিক দাবি শক্তিশালী করার একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে। ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, এই পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে একটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
চিনের পাকিস্তান থেকে মই সরানো এবং এডিবি-এর প্রবেশ একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। পাকিস্তানের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ হলেও, এটি একই সঙ্গে একটি সুযোগ যদি তারা ভ্রষ্টাচার কমিয়ে এবং অর্থনৈতিক সংস্কার গ্রহণ করে। অন্যদিকে, এই ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে। সময় বলবে, এই পরিবর্তন পাকিস্তানের জন্য কতটা কার্যকর হয়।