আজকের ডিজিটাল যুগে ক্রেডিট কার্ড (Credit Card) অনেকেরই দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। শপিং হোক, ইমার্জেন্সি খরচ হোক বা ট্রাভেল বুকিং — সব কিছুই সহজ করে তোলে একটি ক্রেডিট কার্ড। তবে অনেকেই ভুলে যান, এটি কোনও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়ার উপায় নয়। অল্প পরিমাণ বকেয়া রাখলেও, তা খুব দ্রুত বিপুল ঋণে পরিণত হতে পারে। কারণ বার্ষিক সুদের হার ৩৬ থেকে ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে, যা আপনার আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিতে পারে।
অনেকেই ভাবেন, ‘মিনিমাম ডিউ’ বা সর্বনিম্ন বকেয়া টাকা পরিশোধ করলেই বুঝি সব ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তবে এটি একপ্রকার ফাঁদ। কারণ ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিগুলি মাত্র ৫ শতাংশ পরিশোধের সুযোগ দেয়, বাকি ৯৫ শতাংশের ওপর অতিরিক্ত উচ্চ সুদ ধার্য করে।
উদাহরণ হিসেবে, আপনার বিল যদি ৫০,০০০ টাকা হয় এবং আপনি মাত্র ২,৫০০ টাকা দেন, তবে বাকি ৪৭,৫০০ টাকার ওপর ৩–৪ শতাংশ মাসিক সুদ ধার্য হবে। অর্থাৎ, মাসে ১,৪২৫ থেকে ১,৯০০ টাকা শুধু সুদ দিতে হবে। এক বছরে এই সুদের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ১৭,০০০ থেকে ২৩,০০০ টাকা। এইভাবে আপনার ঋণ ক্রমেই বেড়ে যায়, যা অনেকের অজান্তেই ঘটে।
বকেয়া টাকা ও চক্রবৃদ্ধি সুদের প্রভাব:
ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া টাকার ওপর শুধু সুদ নয়, সেই সুদের ওপরও সুদ বসে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় চক্রবৃদ্ধি সুদ। যেমন, ধরুন আপনি ২০,০০০ টাকা বকেয়া রেখে দিলেন এবং মাসিক ৩.৫ শতাংশ হারে সুদ ধার্য হলো। কোনো নতুন খরচ না করলেও এক বছরে সেই টাকা বেড়ে প্রায় ২৮,৫০০ টাকা হয়ে যাবে।
ব্যক্তিগত ঋণের মতো নির্দিষ্ট মেয়াদ বা নিয়মিত কিস্তির ভিত্তিতে ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া পরিশোধ হয় না। ফলে, যত দেরি করবেন, ঋণের পরিমাণ তত বাড়বে। এটি ধীরে ধীরে একটি গভীর ঋণজালে পরিণত হয়।
ইন্টারেস্ট-ফ্রি পিরিয়ডের সুবিধা হারিয়ে ফেলা:
অনেকেই জানেন, ক্রেডিট কার্ডে সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ দিনের ইন্টারেস্ট-ফ্রি পিরিয়ড থাকে। তবে শর্ত হলো, পুরো বিলের টাকা একসাথে পরিশোধ করতে হবে। যদি আংশিক বিল মেটান বা বকেয়া রেখে দেন, তবে নতুন কেনাকাটায় সেই সুবিধা চলে যাবে।
যেমন, জুন মাসের বিল আংশিক পরিশোধ করে যদি জুলাইতে আবার খরচ করেন, সেক্ষেত্রে নতুন খরচের ওপর সঙ্গে সঙ্গে সুদ বসতে শুরু করবে। তখন আর কোনো গ্রেস পিরিয়ড থাকবে না। এইভাবে আপনার ক্রেডিট কার্ড বন্ধুত্বপূর্ণ অর্থের সরঞ্জাম থেকে ধীরে ধীরে ঋণের ফাঁদে পরিণত হয়।
ঋণ সীমা বেশি হলে ক্রেডিট স্কোরে প্রভাব:
অতিরিক্ত ঋণ ব্যবহার করলে আপনার ক্রেডিট স্কোরের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। যদি আপনার কার্ডের সীমা ১ লাখ টাকা হয় এবং আপনি ৮০,০০০ টাকা খরচ করে ফেলেন, তাহলে আপনার ঋণ ব্যবহার হার ৮০ শতাংশ। আদর্শভাবে এই হার ৩০ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।
যদি নিয়মিত সর্বনিম্ন পেমেন্ট দেন এবং ঋণ সীমার প্রায় পুরোটাই ব্যবহার করেন, তা ব্যাংক বা অন্য ঋণদাতাদের কাছে আপনার আর্থিক দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়। ফলে ভবিষ্যতে পার্সোনাল লোন, হোম লোন বা অন্য কোনো বড় ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে।
পরিশোধের সঠিক উপায়:
বিল পরিশোধের সবচেয়ে বুদ্ধিমানের উপায় হলো পুরো টাকা সময়মতো মিটিয়ে ফেলা। এতে আপনার আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় থাকবে এবং ইন্টারেস্ট-ফ্রি পিরিয়ডের সুবিধা পেতে পারবেন। যদি কোনো কারণে পুরো টাকা পরিশোধ সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে লোন ট্রান্সফার করে পার্সোনাল লোনের মাধ্যমে বকেয়া মিটিয়ে দেওয়া ভালো। কারণ পার্সোনাল লোনের সুদের হার তুলনায় অনেক কম (প্রায় ১২–১৫ শতাংশ), যা ক্রেডিট কার্ডের চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী।
সবশেষে বলা যায়, ক্রেডিট কার্ড সঠিকভাবে ব্যবহার করলে তা আপনার লাইফস্টাইল এবং জরুরি খরচে দারুণ সহায়ক। তবে সামান্য অসাবধানতা ও ‘মিনিমাম পেমেন্ট’এর ফাঁদে পা দিলে এটি বিপদজনক হয়ে যেতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা ও নিয়মিত পুরো বিল পরিশোধের মাধ্যমে ঋণমুক্ত থেকে সুস্থ আর্থিক জীবন বজায় রাখুন।