ভারতের টেলিকম সেক্টরে একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সরকারি অধীনস্থ টেলিকম কোম্পানি বিএসএনএল (BSNL) ধীরে ধীরে গ্রাহক হারাচ্ছে। সাম্প্রতিক ট্রাই (টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অফ ইন্ডিয়া) তথ্য অনুযায়ী, জুন ২০২৫ মাসে বিএসএনএলের গ্রাহক সংখ্যা ৩ লক্ষ ৫ হাজার ৭৬৬ জন কমে গেছে। এই হ্রাসের পেছনে প্রযুক্তির পিছিয়ে পড়া, নেটওয়ার্কের দুর্বলতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর আকর্ষণীয় পরিষেবা উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে দেখা গেছে। অন্যদিকে, রিলায়েন্স জিও এবং এয়ারটেলের মতো প্রাইভেট কোম্পানি গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি করছে, যা টেলিকম বাজারে একটি গভীর ভাগাভাগি সৃষ্টি করেছে।
জিও ও এয়ারটেলের দাপট
ট্রাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, জুন ২০২৫-এ জিও ১৯ লক্ষ নতুন গ্রাহক যোগ করেছে, যা এই সেক্টরে তার অপরাজেয় অবস্থান আরও পাকা করে তুলেছে। এয়ারটেলও ৭ লক্ষ ৬৩ হাজার ৪৮২ গ্রাহক নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তবে, ভোডাফোন আইডিয়া (ভিআই) ২ লক্ষ ১৭ হাজার ৮১৬ গ্রাহক হারিয়েছে, যা তার বাজারে অস্থিরতার ইঙ্গিত দেয়। এই তথ্য থেকে পরিষ্কার যে, ৪এজি ও ৫এজি প্রযুক্তির দৌলতে জিও ও এয়ারটেল গ্রাহকদের মনে জয়লাভ করছে, যেখানে বিএসএনএল এখনও ৪এজি পরিষেবা সম্পূর্ণভাবে চালু করতে পারেনি।
বিএসএনএলের পিছিয়ে পড়া
বিএসএনএল, একসময় ভারতের টেলিকম সেক্টরের গর্ব ছিল, আজ তাদের অবস্থা উদ্বেগজনক। ৩ লক্ষেরও বেশি গ্রাহক হারানোর পেছনে প্রধান কারণ হলো তাদের পুরনো প্রযুক্তি ও দুর্বল নেটওয়ার্ক কভারেজ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিএসএনএলের ৪এজি নেটওয়ার্ক রোলআউটে বিলম্ব এবং ৫এজি প্রযুক্তিতে প্রস্তুতি নেওয়ার অক্ষমতা গ্রাহকদের হাত থেকে সরে যাওয়ার মূল কারণ। তাছাড়া, সরকারি নিয়মকানুনের জটিলতা ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এই কোম্পানিকে আরও পিছিয়ে ফেলেছে।
সরকারের পদক্ষেপ: যথেষ্ট কিনা?
সরকার বিএসএনএলকে পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন গ্রিন টাওয়ার প্রকল্প এবং উৎপাদন-সংযুক্ত উৎসাহ প্রণোদনা (পিএলআই) স্কিম। তবে, এই পদক্ষেপগুলো এখনও ফল দেওয়া থেকে বঞ্চিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিএসএনএলকে প্রতিযোগিতার মাঠে ফিরিয়ে আনতে হলে দ্রুত ৫এজি নেটওয়ার্ক চালু করা এবং গ্রাহক-কেন্দ্রিক পরিষেবা উন্নত করা জরুরি। তাছাড়া, সরকারের দ্বারা প্রদত্ত অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা বাড়াতে হবে, যা বর্তমানে পর্যাপ্ত মাত্রায় দেখা যাচ্ছে না।
গ্রাহকদের দৃষ্টিকোণ
পশ্চিমবঙ্গে অনেক গ্রাহক বিএসএনএলের সাথে তারা যে দুর্বল সংযোগ এবং উচ্চ কল ড্রপ রেটের সমস্যা অনুভব করছেন, তার কারণে অন্য কোম্পানির দিকে ঝুঁকছেন। একজন কলকাতার গ্রাহক বলেন, “বিএসএনএলের ইন্টারনেট স্পিড এতটাই ধীর যে কাজ করা অসম্ভব। জিওতে সুইচ করার পর আমি স্বস্তি পেয়েছি।” এই ধরনের মন্তব্য বাড়ছে, যা বিএসএনএলের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
ভারতের টেলিকম সেক্টরে এলন মাস্কের স্টারলিঙ্কের প্রবেশের কথা উঠছে, যা বাজারে আরও প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বিএসএনএলের জন্য সময় কমে আসছে। যদি সরকার দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়, তবে বিএসএনএলের বাজারে অবস্থান আরও দুর্বল হতে পারে। তবে, কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন যে, সরকারি সমর্থনের সুবাদে বিএসএনএল এখনও ফিরে আসার সুযোগ রাখে, তবে তা জরুরি রূপান্তরের মাধ্যমে সম্ভব।
বিএসএনএলের গ্রাহক হ্রাস টেলিকম সেক্টরে একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। জিও ও এয়ারটেলের দাপটের মুখে এই সরকারি কোম্পানির জন্য পুনরুদ্ধারের পথ খুঁজে বের করা জরুরি। সরকার, নীতিনির্ধারক ও বিএসএনএলের ব্যবস্থাপনার মধ্যে সমন্বয় এবং প্রযুক্তিগত উন্নতি ছাড়া এই কোম্পানি বাজারে টিকে থাকতে পারবে না। পশ্চিমবঙ্গসহ সমগ্র ভারতে গ্রাহকদের প্রত্যাশা এখন উচ্চ, এবং বিএসএনএলের জন্য এটি একটি সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ উভয়ই। সরকার যদি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে ভবিষ্যতে বিএসএনএলের অবস্থান আরও বিপন্ন হতে পারে।