নতুন আয়কর আইন (Income-Tax Bill) বাস্তবায়নের পথে আরও এক ধাপ এগোল ভারত। ২০২৫ সালের আয়কর বিল নিয়ে সংসদীয় বাছাই কমিটি সোমবার লোকসভায় তাদের বিশদ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ৪,৫৮৪ পাতার এই বিশাল রিপোর্টে মোট ৫৬৬টি নির্দিষ্ট সুপারিশ রাখা হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য হলো আইনের সংজ্ঞাগুলি পরিশোধন, বিভ্রান্তি হ্রাস এবং বর্তমান অন্যান্য আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখা।
বিলের পর্যালোচনা ও সংস্কারের উদ্দেশ্য:
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সংসদে প্রস্তাবিত আয়কর বিল, ২০২৫ মূলত ১৯৬১ সালের আয়কর আইনের পরিপূর্ণ সংস্করণ। এতে আইনের কাঠামো এবং ভাষা আরও সরল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেন সাধারণ করদাতার পক্ষে তা বোঝা এবং প্রয়োগ সহজ হয়। সংসদীয় কমিটি বিলটি নিয়ে ব্যাপক পরামর্শ করে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার, আইন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার মতামত গ্রহণ করে।
দেরিতে রিটার্ন জমা দিলেও কর ফেরতের সুযোগ চায় কমিটি:
সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলির মধ্যে একটি হলো ছোট করদাতাদের জন্য কর ফেরতের ক্ষেত্রে নমনীয়তা বৃদ্ধি। বর্তমানে, যারা নির্ধারিত সময়ের পরে রিটার্ন জমা দেন তারা কর ফেরত পাওয়ার অধিকার হারান। কিন্তু কমিটি মনে করে, অনেক মানুষ করযোগ্য আয়ের নিচে থাকলেও তাদের উৎসে কর কাটা (TDS) হয়, ফলে তাদের ফেরত পাওয়ার অধিকার থাকা উচিত। তাই তারা প্রস্তাব দিয়েছে, সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও এমন করদাতাদের রিটার্ন গ্রহণ করে ফেরত দেওয়া হোক।
কমিটির মতে, আইন যেন মানুষের ওপর চাপ তৈরি না করে, বরং কর প্রদানকে সহজ ও সহনশীল করে তোলে। বিশেষ করে যারা কম আয়ের এবং করযোগ্য সীমার নিচে, তাদের জন্য আইনি ছাড় এবং ফেরতের সুযোগ রাখা উচিত।
সম্পত্তি মালিকদের জন্য সুসংবাদ:
সম্পত্তি আয়ের ক্ষেত্রে বড় একটি পরিবর্তনের প্রস্তাব রেখেছে কমিটি। তারা পরামর্শ দিয়েছে যে, বাৎসরিক মূল্যের ওপর ৩০% মানদণ্ড ছাড় দেওয়া হোক পৌরকর কেটে নেওয়ার পরে। এর ফলে সম্পত্তি আয়ের হিসাব আরও বাস্তবধর্মী হবে এবং করের বোঝা হ্রাস পাবে।
এছাড়া, প্রাক-নির্মাণ সুদের ছাড়ের সুযোগ যেন ভাড়ার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সম্পত্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়, সেই প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। বর্তমানে এই সুবিধা মূলত আত্মব্যবহৃত সম্পত্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
স্বচ্ছতা বাড়াতে চ্যারিটি ও এনজিওদের জন্য সুপারিশ:
কমিটি অলাভজনক সংস্থাগুলোর জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তারা বলেছে, ‘আয়’ ও ‘প্রাপ্তি’র সংজ্ঞা আরও স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে এবং ‘অজানা দানের’ (anonymous donation) নিয়মগুলি নিয়ে স্পষ্ট দিশা দেওয়া জরুরি।
এছাড়া, “deemed application” ধারাটি বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে, যা বর্তমানে অনেক আইনি জটিলতার কারণ হয়। এই পরিবর্তন চ্যারিটি সংগঠনগুলিকে আর্থিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে এবং দীর্ঘমেয়াদী মামলা এড়াতে সহায়ক হবে।
প্রক্রিয়াগত দিকগুলিতে সরলতা আনার লক্ষ্যে পরিবর্তন
বিলের বিভিন্ন প্রশাসনিক দিকও সরল ও আধুনিক করার প্রস্তাব রেখেছে কমিটি। এর মধ্যে আছে:
অগ্রিম সিদ্ধান্ত (Advance Ruling) ফি নিয়ে স্পষ্ট নিয়মাবলী
ভবিষ্য তহবিল (Provident Fund) তোলার সময় TDS সংক্রান্ত বিধান
কম হারে কর কর্তনের জন্য সার্টিফিকেট প্রদান
জরিমানা ধার্য করার ক্ষমতা নিয়ে স্পষ্টীকরণ
এছাড়া, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোগের (Micro and Small Enterprises) সংজ্ঞা যেন MSME আইন অনুযায়ী নির্ধারিত হয়, সেই সুপারিশ করা হয়েছে। এর ফলে একই সংস্থাকে আলাদা আইন অনুযায়ী আলাদা সংজ্ঞায় পড়তে হবে না এবং প্রশাসনিক বোঝা হ্রাস পাবে।
কর সংস্কারে নতুন দিগন্ত:
২০২৫ সালের আয়কর বিল ভারতীয় কর ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সংসদীয় কমিটির এই বিস্তারিত প্রতিবেদন সরকারের কাছে একটি গাইডলাইন হিসাবে কাজ করবে, যাতে আইনের চূড়ান্ত রূপ বাস্তবসম্মত, সহজবোধ্য এবং জনগণের পক্ষে সহায়ক হয়।
এই বিল সংসদে পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনার জন্য উঠবে, এবং কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সংশোধনগুলি অনুমোদিত হলে, তা দেশের লক্ষ লক্ষ করদাতার জন্য বড় স্বস্তি নিয়ে আসবে। ছোট করদাতা, গৃহ-মালিক, অলাভজনক সংস্থা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য এই বিল হতে চলেছে একটি সহায়ক হাতিয়ার।