হাসিনা দেশ ছাড়তেই বাংলাদেশের হাজার কোটি টাকা গিয়েছে সুইস ব্যাংকে

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে (Swiss banks) বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ গত এক বছরে ৩৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) সাম্প্রতিক বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে…

Swiss banks, Bangladesh, money laundering, political instability

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে (Swiss banks) বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ গত এক বছরে ৩৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) সাম্প্রতিক বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা ২০২৩ সালে ছিল মাত্র ১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় এই পরিমাণ প্রায় ৮,৭৮৪ কোটি টাকার সমান (১ সুইস ফ্রাঁ = ১৪৯ টাকা ধরে)। এই হঠাৎ বৃদ্ধির পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থ পাচার এবং আন্তর্জাতিক অর্থ স্থানান্তরের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।

Advertisements

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এই ঘটনার পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী এবং সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা দেশ ত্যাগ করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই সময়ে অনেকে তাদের জমানো অর্থ বিদেশে স্থানান্তর করেছেন। সুইস ব্যাংকে অর্থ জমার এই বৃদ্ধি এই ধারণাকে আরও জোরালো করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত শুরু হয়েছে, যার ফলে অনেকে অর্থ এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তর করছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

   

সুইস ব্যাংকের আকর্ষণ ও অর্থ পাচারের ইতিহাস
একসময় সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো অর্থ পাচারকারীদের জন্য অন্যতম পছন্দের গন্তব্য ছিল। এর কারণ ছিল সুইস ব্যাংকগুলোর কঠোর গোপনীয়তা নীতি, যা অন্য দেশের সরকারের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানে বাধা সৃষ্টি করত। তবে, গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক চুক্তির কারণে এই দৃশ্যপট পাল্টেছে। এখন সুইজারল্যান্ড অন্যান্য দেশের সরকারের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করে। ফলে, অর্থ পাচারকারীরা সুইজারল্যান্ডের পরিবর্তে অন্য দেশের ব্যাংকগুলোতে অর্থ জমা রাখছে। তবুও, ২০২৪ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের এই বৃদ্ধি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, “সুইজারল্যান্ড এখন অর্থ পাচারকারীদের কাছে খুব বেশি আকর্ষণীয় নয়। বিশ্বের অনেক দেশ এখন পাচারকারীদের জন্য নিরাপদ এবং সহজ বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে।” তিনি আরও জানান, বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১,৬০০ কোটি ডলার) পাচার হতো। এই তুলনায় সুইস ব্যাংকের জমা অর্থের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। প্রথমত, তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, জমা অর্থের হিসাবে পদ্ধতিগত কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা, যার কারণে অতীতে অগ্রাহ্য করা হিসাবগুলো এখন বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অর্থ সুইস ব্যাংকে স্থানান্তরিত হচ্ছে কিনা। তৃতীয়ত, সরকার বদলের পর অর্থ পাচার রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও, সুইস ব্যাংকে অর্থের এই বৃদ্ধি পাচার বন্ধের নিশ্চয়তা দেয় না।

বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, সুইস ব্যাংকে জমা অর্থ শুধু বাংলাদেশের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের অর্থও এতে অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বৈধভাবে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখে। তবে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থ পাচারের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

অন্যান্য দেশের প্রেক্ষাপট
সুইস ব্যাংকে শুধু বাংলাদেশিদের অর্থই বাড়েনি, ভারতীয় নাগরিকদের জমা অর্থও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালে ভারতীয়দের জমা অর্থ ছিল ১০৩ কোটি সুইস ফ্রাঁ, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫০ কোটি ফ্রাঁ। এই তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে, অর্থ পাচার বা স্থানান্তরের প্রবণতা শুধু বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

অর্থ পাচার রোধে চ্যালেঞ্জ
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংکগুলো এখন আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় থাকলেও, অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা এখনও দুর্বল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সুইস ব্যাংকে অর্থ জমার বৃদ্ধি কেবল একটি দিক। অন্যান্য দেশে অর্থ পাচারের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য। অর্থ পাচার রোধে কার্যকর আইন প্রয়োগ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং স্বচ্ছ আর্থিক ব্যবস্থার প্রয়োজন।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমার এই ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। এটি দেশের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ও সুশাসনের প্রশ্ন তুলেছে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এই বিষয়ে স্বচ্ছ তদন্ত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।