জীবন অনিশ্চিত। আমরা কেউই জানি না ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে। এই অনিশ্চয়তার মাঝেই পরিবারের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে টার্ম ইন্সুরেন্স (Term Insurance Plan) একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। টার্ম ইন্সুরেন্স হল এমন এক ধরনের জীবনবিমা, যা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য কভারেজ দেয়। পলিসি টার্ম চলাকালীন বিমাধারীর মৃত্যু হলে পরিবার এককালীন টাকার পরিমাণ পেয়ে থাকে। এটি পরিবারকে আর্থিকভাবে সুরক্ষিত রাখতে বিশেষভাবে সহায়ক।
তবে বাজারে বিভিন্ন ধরনের টার্ম ইন্সুরেন্স উপলব্ধ থাকায় অনেক সময় মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, যা পরবর্তীতে বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই টার্ম প্ল্যান কেনার সময় কিছু সাধারণ ভুল থেকে সাবধান থাকা অত্যন্ত জরুরি।
এখানে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ভুলের কথা তুলে ধরা হলো, যা আপনাকে এড়িয়ে চলতে হবে —
১. সঠিক কভারেজ প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ না করা:
সবচেয়ে বড় ভুলের একটি হল, আপনার পরিবারের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী সঠিক কভারেজের পরিমাণ হিসাব না করা। অনেকেই কম প্রিমিয়ামের লোভে খুব কম ‘সাম অ্যাসিউরড’ (যে টাকার অঙ্ক মৃত্যুর পর পরিবার পাবে) বেছে নেন। এর ফলে আপনার পরিবারের আর্থিক সুরক্ষা যথেষ্ট থাকে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আপনার বার্ষিক আয়ের ১০ থেকে ১৫ গুণ কভারেজ রাখা উচিত। সেই সঙ্গে, ইনফ্লেশন, চলমান ঋণ এবং ভবিষ্যতের খরচ যেমন সন্তানদের শিক্ষা বা বিবাহের খরচও মাথায় রাখতে হবে। সঠিক কভারেজ হিসাব না করলে আপনার পরিবার পরবর্তীতে আর্থিক সঙ্কটে পড়তে পারে।
২. শুধুমাত্র কম প্রিমিয়ামের উপর গুরুত্ব দেওয়া:
অনেক সময় মানুষ শুধুমাত্র কম প্রিমিয়ামের জন্য প্ল্যান বেছে নেন। যদিও কম প্রিমিয়াম প্রাথমিকভাবে অর্থ সাশ্রয়ের মতো মনে হয়, কিন্তু এতে প্রয়োজনীয় কভারেজ ও বর্ধিত সুবিধাগুলি বাদ পড়তে পারে।
কম প্রিমিয়ামের পলিসি প্রায়ই সীমিত বেনিফিট, কম রাইডার (অতিরিক্ত সুবিধা) অথবা কম ফ্লেক্সিবিলিটি দেয়। এছাড়া, বিমা কোম্পানির ক্লেইম সেটেলমেন্ট রেশিও বা নির্ভরযোগ্যতা কম থাকতে পারে। তাই শুধু প্রিমিয়ামের দিকে না তাকিয়ে পলিসির সুবিধা, শর্ত এবং কোম্পানির রেপুটেশন যাচাই করে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
৩. মেডিক্যাল ইতিহাস এবং জীবনযাত্রা সম্পর্কিত তথ্য লুকানো:
আরেকটি গুরুতর ভুল হল, প্রিমিয়াম কমানোর জন্য স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য বা অভ্যাস লুকানো। যেমন, অনেকেই ধূমপান বা অ্যালকোহল গ্রহণের তথ্য দেন না অথবা কোনো রোগের ইতিহাস আড়াল করেন। ফলে, মৃত্যুর পর ক্লেইম প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হয় এবং বিমা সংস্থা ক্লেইম রিজেক্ট করতে পারে।
তাই আবেদন করার সময় সম্পূর্ণ সৎ থেকে সব তথ্য স্পষ্টভাবে জানানো উচিত। প্রিমিয়াম হয়তো কিছুটা বেশি হবে, কিন্তু এর ফলে পরিবারের সদস্যরা সহজে ক্লেইম পেতে পারেন এবং ভবিষ্যতে কোনো আইনি জটিলতা তৈরি হবে না।
৪. বিভিন্ন বিমা কোম্পানির টার্ম প্ল্যানের তুলনা না করা:
অনেকেই শুধুমাত্র এজেন্টের পরামর্শে বা পরিচিতদের সুপারিশে টার্ম ইন্সুরেন্স কিনে নেন। এতে তারা অনেক ভালো বিকল্প হাতছাড়া করে ফেলেন।
বর্তমানে অনলাইনে সহজেই বিভিন্ন বিমা কোম্পানির টার্ম প্ল্যানের শর্ত, কভারেজ এবং প্রিমিয়াম তুলনা করা যায়। এতে আপনি বুঝতে পারবেন কোন প্ল্যানটি আপনার প্রয়োজন ও বাজেটের সঙ্গে সবচেয়ে মানানসই। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই অনলাইনে যথেষ্ট রিসার্চ করে এবং তুলনা করে পলিসি বেছে নিন।
৫. পলিসি রিভিউ না করা:
অনেকেই পলিসি নেওয়ার পর তা ভুলে যান এবং কোনোদিনও তা রিভিউ করেন না। জীবনের বড় পরিবর্তন যেমন বিয়ে, সন্তান জন্ম, বা বড় ঋণ নেওয়ার সময় আপনার কভারেজের প্রয়োজনীয়তাও পরিবর্তিত হয়।
তাই ideally, প্রতি ৩-৫ বছরে বা কোনো বড় জীবনঘটনার পরে আপনার পলিসি রিভিউ করা উচিত। এতে আপনার কভারেজ সব সময় আপডেট থাকবে এবং পরিবারের সুরক্ষায় কোনো ফাঁক থাকবে না।
টার্ম ইন্সুরেন্স প্ল্যান কেনা মানে শুধু একটি পলিসি নেওয়া নয়, বরং পরিবারের ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করা। সঠিক পরিকল্পনা ও সতর্কতার সঙ্গে টার্ম প্ল্যান বেছে নিলে মৃত্যুর পরও পরিবারের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।
অতএব, কভারেজের পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ধারণ, তথ্য গোপন না করা, সঠিকভাবে তুলনা করা, এবং নিয়মিত রিভিউ করা — এই সহজ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মেনে চললে আপনার টার্ম ইন্সুরেন্স হবে সঠিক অর্থে কার্যকর। পরিবারের আর্থিক সুরক্ষার জন্য এটি একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ।