দিল্লি ও জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের (Delhi NCR) বায়ু দূষণ রোধে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে Commission for Air Quality Management (CAQM)। আগামী ১ জুলাই ২০২৫ থেকে দিল্লিতে নির্ধারিত বয়সসীমা অতিক্রান্ত গাড়িগুলিতে জ্বালানি ভরার অনুমতি থাকবে না। এই সিদ্ধান্তে ডিজেলচালিত ১০ বছরের বেশি পুরনো এবং পেট্রোলচালিত ১৫ বছরের বেশি পুরনো গাড়িগুলিকে End-of-Life (EoL) বা অবসানপ্রাপ্ত গাড়ি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে এবং তাদের জ্বালানি সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় কড়া নজরদারি:
এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য দিল্লির ৫০০টি পেট্রোল পাম্পে Automatic Number Plate Recognition (ANPR) প্রযুক্তি সংযুক্ত ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এই ক্যামেরাগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিটি গাড়ির নম্বর প্লেট স্ক্যান করে তাৎক্ষণিকভাবে VAHAN ডাটাবেস-এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখে গাড়িটির নিবন্ধন, জ্বালানি ধরন ও বয়স।
যদি কোনো গাড়ি সরকার নির্ধারিত সীমার বাইরে থাকে, তাহলে পাম্প অপারেটরদের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে সতর্কতা পাঠানো হয় এবং সেই গাড়িটিকে জ্বালানি না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। নিয়ম লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট গাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে জরিমানা, গাড়ি আটক বা স্ক্র্যাপ করার মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
৪.৯ লক্ষ পুরনো গাড়ি শনাক্ত:
CAQM-এর সদস্য ডঃ বীরেন্দ্র শর্মা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ৩.৬৩ কোটির বেশি গাড়ি স্ক্যান করা হয়েছে, যার মধ্যে ৪.৯০ লক্ষ গাড়িকে End-of-Life হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “পুরনো BS (Bharat Stage) মানের গাড়িগুলি দিল্লি ও এনসিআর অঞ্চলে বায়ু দূষণের একটি বড় উৎস। এই ডিজিটাল ব্যবস্থা কেবলমাত্র পেট্রোল পাম্পেই নয়, টোল সেন্টারেও ব্যবহার করা হবে। প্রায় ১০০টি এনফোর্সমেন্ট টিম প্রতিনিয়ত এই ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে কাজ করছে।”
দিল্লি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয় উদ্যোগ:
এই নীতি শুধু দিল্লির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আগামী ১ নভেম্বর ২০২৫ থেকে গুরগাঁও, ফারিদাবাদ, গাজিয়াবাদ, গৌতম বুদ্ধ নগর ও সোনিপত এলাকায়ও এটি কার্যকর হবে। পরবর্তী ধাপে ১ এপ্রিল ২০২৬ থেকে পুরো National Capital Region (NCR)-এ এটি কার্যকর করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এই ধাপে ধাপে প্রয়োগের উদ্দেশ্য হলো, প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগতভাবে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মসৃণভাবে ব্যবস্থাটি কার্যকর করা।
পরিবহন দপ্তরের সক্রিয় পদক্ষেপ:
দিল্লি পরিবহন দপ্তর এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য ১০০টি বিশেষ টিম গঠন করেছে, যারা পেট্রোল পাম্পগুলিতে নিয়মিত নজরদারি চালাচ্ছে। যারা নিয়ম অমান্য করছে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও যেসব এলাকায় পুরনো গাড়ির সংখ্যা বেশি, সেসব এলাকাকে বিশেষ নজরে রাখা হচ্ছে।
ডঃ শর্মা জানান, এই ব্যবস্থার ফলে ইতিমধ্যে ২৯.৫২ লক্ষ গাড়ির Pollution Under Control (PUC) সার্টিফিকেট নবায়ন হয়েছে এবং সরকার ১৬৮ কোটি টাকারও বেশি চালান সংগ্রহ করেছে। এটি স্পষ্ট যে, প্রশাসনের সক্রিয়তা এবং প্রযুক্তিনির্ভর পদক্ষেপের ফলে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিবেশ রক্ষায় এই নীতির প্রভাব:
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই কৌশলগত পদক্ষেপটি দিল্লি ও আশেপাশের অঞ্চলের বায়ু মান উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বহুদিন ধরেই পরিবেশবিদ ও আদালত গুলি দিল্লির বায়ু দূষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন। পুরনো গাড়ি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া ও টক্সিক গ্যাস শহরের বায়ুতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ANPR-ভিত্তিক এই প্রযুক্তি শুধু দূষণ রোধে নয়, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও কার্যকর নজরদারি নিশ্চিত করতে সাহায্য করছে।
জনসচেতনতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা:
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এই উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে। পেট্রোল পাম্প ও জনবহুল স্থানে সচেতনতা পোস্টার, ডিজিটাল বোর্ড, ও প্রচারাভিযানের মাধ্যমে মানুষকে জানানো হচ্ছে যে পুরনো গাড়ি চালিয়ে তারা পরিবেশের ক্ষতি করছেন এবং নিজেরাও জরিমানার মুখোমুখি হতে পারেন।
১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ প্রযুক্তি ও প্রশাসনিক সমন্বয়ের একটি সফল দৃষ্টান্ত। পুরনো, দূষণকারী গাড়ির বিরুদ্ধে এমন কঠোর পদক্ষেপ শুধু রাজধানী নয়, গোটা দেশের জন্য একটি অনুকরণীয় মডেল হতে পারে। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, প্রশাসনিক সদিচ্ছা এবং জনসচেতনতা—এই তিনটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই পদক্ষেপ যে দিল্লির বায়ুকে পরিচ্ছন্ন করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে, তা বলাই বাহুল্য। পরিবেশ বাঁচাতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য শহর গড়ে তুলতে এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।