বিশ্ব তেলবাজারে বড়সড় মোড় নেওয়ার পথে। ওপেক+ (OPEC oil production) জোটের আটটি প্রধান সদস্য দেশ — সৌদি আরব, রাশিয়া, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাজাখস্তান, আলজেরিয়া এবং ওমান — আগামী সেপ্টেম্বর ২০২৫ থেকে দৈনিক ৫.৪৭ লক্ষ ব্যারেল করে অপরিশোধিত তেল উৎপাদন বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।
এই আটটি দেশকে একত্রে ‘ভলান্টারি এইট’ (V8) বলা হচ্ছে, যারা নিজেদের বাজারে আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ওপেক+ উৎপাদন কমিয়ে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল নিয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববাজারে তেলের দাম স্থিতিশীল থাকায় এবং গ্লোবাল অর্থনীতির স্থিতিশীল পূর্বাভাসের প্রেক্ষিতে তারা ফের উৎপাদন বাড়ানোর পথে হাঁটছে।
যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা:
ভলান্টারি এইট-এর পক্ষ থেকে দেওয়া এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা এবং কম তেল মজুদের মতো সুস্থ বাজার পরিস্থিতিকে বিবেচনায় রেখে, আমরা আগামী সেপ্টেম্বর থেকে আগের মাসের তুলনায় ৫,৪৭,০০০ ব্যারেল বেশি উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
এই ঘোষণা তেলবাজারে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। কারণ, ওপেক+ দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন কমিয়ে তেলের দাম উচ্চ রাখতে চাইছিল। কিন্তু বর্তমানে যখন রাশিয়ার ডিসকাউন্টে বিক্রি হওয়া অপরিশোধিত তেল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের চাপও বাড়ছে, তখন ওপেক+ নিজের বাজার শেয়ার ধরে রাখতে এই পরিবর্তনের পথে হাঁটছে।
মার্কিন চাপ এবং ভারতের ভূমিকা:
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, রাশিয়া যদি ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ না করে, তবে যারা রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছে, তাদের উপর কঠোর শুল্ক আরোপ করা হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের নাম বিশেষভাবে উঠে এসেছে।
ট্রাম্প হুমকি দিয়ে বলেন, “আমরা ট্যারিফ আরোপ করব — ১০০ শতাংশ পর্যন্ত,” এবং পরোক্ষভাবে ভারতকে লক্ষ্য করেন, যেহেতু ভারত বর্তমানে দৈনিক গড়ে ১.৬ মিলিয়ন ব্যারেল রাশিয়ান তেল আমদানি করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই হুমকিই বিশ্ব তেলবাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। একদিকে ওপেক+ উৎপাদন বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞার সম্ভাবনা তেলের সরবরাহে নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে।
বাজার শেয়ার বনাম দাম নিয়ন্ত্রণ:
বিশ্বের তেল উৎপাদক দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে উৎপাদন হ্রাস করেছিল। তবে বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, সেই নীতিতে পরিবর্তন আসছে। ওপেক+ এখন বাজার শেয়ার ধরে রাখাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বিশেষ করে যখন নন-ওপেক দেশগুলি যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল এবং কানাডা উৎপাদন বাড়াচ্ছে, তখন ওপেক+ নিজেদের আধিপত্য হারাতে চায় না।
বিশ্লেষক জিওভান্নি স্টাওনোভো বলেন, “ওপেক+ শুধুমাত্র তখনই প্রতিক্রিয়া জানাবে, যখন বাস্তবিকভাবে সরবরাহে বিঘ্ন ঘটবে। শুধুমাত্র দামের উপর ভিত্তি করে তারা সিদ্ধান্ত নেবে না।”
ভারতের উপর কী প্রভাব পড়বে?
ভারতের জন্য এই পরিস্থিতি বেশ জটিল। একদিকে ভারতের শক্তি চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে এবং রাশিয়ার তেল তুলনামূলকভাবে সস্তা। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে ভারতকে নতুন বিকল্প খুঁজতে হবে অথবা বেশি দামে তেল কিনতে হবে, যা দেশের মুদ্রাস্ফীতির উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত সরকার এখনো ট্রাম্পের হুমকির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। যদি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং নতুন নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়িত হয়, তাহলে ভারতের আমদানির খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে।
ওপেক+ এর এই নতুন সিদ্ধান্ত বিশ্বজুড়ে জ্বালানি বাজারে উত্তেজনা তৈরি করেছে। একদিকে উৎপাদন বাড়ার ফলে সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে এবং দাম কিছুটা কমতে পারে, অন্যদিকে রাজনৈতিক চাপ ও সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার ফলে বাজার আবারও অস্থির হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতি ও আমদানিকারক দেশগুলির জন্য আগামী কয়েক মাস জ্বালানি কৌশল পুনর্বিবেচনার সময় হতে চলেছে। ভারতসহ সব দেশের কাছে এখন বড় প্রশ্ন— উৎপাদনের বাড়তি সরবরাহে সুবিধা নেওয়া যাবে তো? নাকি ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি তাদের আবার বিপাকে ফেলবে? সময়ই এর উত্তর দেবে।