ভারতের প্রাক্তন দিল্লি মুখ্যমন্ত্রী এবং আম আদমি পার্টির (এএপি) জননেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল (Arvind Kejriwal) আবারও একটি বিতর্কিত বিষয়ে মনোযোগ কাড়ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা ভারতীয় আমদানি পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রতিবাদে তিনি মার্কিন পণ্যের উপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের দাবি জানিয়েছেন। এই প্রস্তাবটি ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। কেজরিওয়ালের এই বক্তব্যটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, যা ভারতের জনগণের মধ্যে বিভিন্ন মতামতের সৃষ্টি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকার গত ২৭ আগস্ট থেকে ভারতীয় আমদানি পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যার প্রধান কারণ হিসেবে ভারতের রাশিয়া থেকে সস্তা তেল আমদানি করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের মতে, ভারতের এই পদক্ষেপ রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থায়নের ক্ষেত্রে সহায়তা করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই শুল্ক আরোপ একটি অবিচারপূর্ণ পদক্ষেপ, কারণ ভারত তার শক্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করছে, যা বিশ্ববাজারে তেলের দামের অস্থিরতার মধ্যে একটি বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ। রয়টার্সের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত ভারত প্রতিদিন ১.৭৩ মিলিয়ন ব্যারেল রাশিয়ান ক্রুড তেল আমদানি করেছে, যা তাদের বার্ষিক $৫-৭ বিলিয়ন বাঁচিয়ে দিয়েছে।
Also Read | রাশিয়ার তেলে ভারতের লাভের অঙ্ক নিয়ে গুজব! উত্তর দিল কেন্দ্র
এই প্রেক্ষাপটে কেজরিওয়ালের ১০০ শতাংশ শুল্কের প্রস্তাবটি একটি প্রতিশোধী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তিনি দাবি করেছেন যে যদি যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধে এই ধরনের অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে, তবে ভারতেরও সমানভাবে উত্তর দেওয়া উচিত। তাঁর মতে, এই শুল্ক আরোপ ভারতীয় রপ্তানিকারকদের জন্য বিপর্যয়কর হবে, যা প্রায় $৪৮ বিলিয়ন মূল্যের রপ্তানি ব্যবসায় প্রভাব ফেলতে পারে, যা গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কেজরিওয়ালের এই বক্তব্যের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলেও কিছু বিশ্লেষকের মত রয়েছে, যেহেতু তিনি বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে একটি সংঘাতমূলক ভূমিকা গ্রহণ করছেন।
ভারতীয় অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্সের একটি গবেষণা অনুযায়ী, শুল্কযুদ্ধ সাধারণত বিশ্ব বাণিজ্য দক্ষতায় ১-২ শতাংশ কমিয়ে দেয় এবং গ্লোবাল জিডিপি-তে ০.২-০.৪ শতাংশ হ্রাস আনে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ নিজেদের অর্থনীতির উপরও প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ ভারত তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সঙ্গী। তবে কেজরিওয়ালের ১০০ শতাংশ শুল্কের প্রস্তাব বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, কারণ এটি ভারতীয় গ্রাহকদের জন্য আমেরিকান পণ্যের দাম বৃদ্ধি করবে এবং উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও জটিল করে তুলতে পারে।
সামাজিক মাধ্যমে এই বিষয় নিয়ে মতামত বিভিন্ন। কেউ কেজরিওয়ালের প্রস্তাবকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, অন্যদের মতে তিনি অপ্রয়োজনীয়ভাবে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বাড়াবাড়ি করছেন। কিছু ব্যবহারকারী কেজরিওয়ালের উপর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের অভিযোগ তুলেছেন, যিনি দাবি করছেন যে তিনি ভারতের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এই পদক্ষেপের পক্ষে। তবে বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের শুল্কযুদ্ধ উভয় দেশের জনগণের জীবিকাকে ক্ষতি করতে পারে, বিশেষ করে ভারতের পোশাক, রত্ন ও গয়না, চামড়া পণ্য এবং খাদ্য খাতের ক্ষেত্রে, যেখানে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের চাকরি বিপন্ন হতে পারে।
ভারত সরকার এখনও কেজরিওয়ালের প্রস্তাবের উপর কোনো সরাসরি মন্তব্য করেনি। তবে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ স্তরে আলোচনা চালাচ্ছে এবং বিকল্প বাজার খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে, যেমন লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। এদিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতীয় কৃষক এবং ছোট ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা এই পরিস্থিতিতে তাঁর কঠিন দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেয়।
সারা সারা, কেজরিওয়ালের ১০০ শতাংশ শুল্কের দাবি ভারতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে একটি নতুন মোচড় যোগ করেছে। তবে এই পদক্ষেপের সফলতা নির্ভর করবে ভারতের বৈদেশিক নীতি এবং অর্থনৈতিক কৌশলের উপর। এটি শুধুমাত্র একটি বিতর্কের বিষয় নয়, বরং ভারতের ভবিষ্যৎ বাণিজ্য নীতির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত। যদি এই শুল্কযুদ্ধ বাড়ে, তবে এর ফলে উভয় দেশের জনগণের জীবনযাত্রায় গভীর প্রভাব পড়তে পারে।