৩৭০ প্রত্যাহারের প্রভাবে জম্মু-কাশ্মীরে ২০০ কোটির কারখানা কলকাতার বাঙালি শিল্পপতির

বছর ছয়েক আগে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট, কেন্দ্র সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও ৩৫-এ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে। মোদী…

Article 370 Repeal Spurs ₹200 Crore Kolkata Industrial Eveready Industries Investment in Jammu

বছর ছয়েক আগে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট, কেন্দ্র সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও ৩৫-এ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে। মোদী সরকারের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের পর থেকেই রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা শুরু হয়—এখন কি ভারতের যেকোনও প্রান্তের মানুষ ভূস্বর্গে জমি কিনতে ও ব্যবসা করতে পারবে? বিজেপি নেতারা দাবি করেছিলেন, এতে বাংলার শিল্পপতিরাও সুযোগ পাবেন কাশ্মীরে শিল্প স্থাপনের (Jammu investment)। বিরোধী শিবির, বিশেষত তৃণমূল ঘনিষ্ঠরা, তখন এই দাবিকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন—এ সবই রাজনৈতিক প্রচার, বাস্তবায়ন অসম্ভব।

কিন্তু সেই সন্দেহকে এবার কার্যত অগ্রাহ্য করেই, কলকাতার বিখ্যাত শিল্পসংস্থা এভারেডি ইন্ডাস্ট্রিজ ইন্ডিয়া লিমিটেড জম্মুতে ২০০ কোটি টাকার একটি অত্যাধুনিক অ্যালকালাইন ব্যাটারি উৎপাদন কারখানা স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। এই পদক্ষেপ প্রমাণ করছে যে, ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের পর কাশ্মীরে শিল্প বিনিয়োগের দরজা সত্যিই খুলে গেছে।

   

জম্মুতে প্রথম অ্যালকালাইন ব্যাটারি কারখানা
ভারতের ব্যাটারি শিল্পের পথিকৃৎ এভারেডি জানিয়েছে, চলতি অর্থবর্ষের মধ্যেই জম্মুতে এই কারখানা চালু হবে। সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর শুভময় সাহা জানিয়েছেন—এই কারখানায় বছরে প্রায় ৩৬ কোটি অ্যালকালাইন ব্যাটারি উৎপাদনের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশের ব্যাটারি বাজারের একটি বড় অংশ বিদেশি আমদানির উপর নির্ভরশীল। দেশীয় উৎপাদন বাড়লে কেবল আমদানি ব্যয়ই কমবে না, বরং ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগও বড় গতি পাবে।

জম্মু কেন নির্বাচিত?
এভারেডির মতে, জম্মু এই প্রকল্পের জন্য আদর্শ স্থান, কারণ—

  1. কৌশলগত অবস্থান: উত্তর ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বাজারে দ্রুত পৌঁছানো যাবে।
  2. শিল্প-বান্ধব নীতি: কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কর ছাড় ও বিনিয়োগ প্রণোদনা রয়েছে।
  3. লজিস্টিক সুবিধা: প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদান এবং কাঁচামাল সহজলভ্য।
  4. প্রশাসনিক সহায়তা: স্থানীয় সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা।

এছাড়াও, জম্মু ও কাশ্মীরে শান্তি-শৃঙ্খলা ও অবকাঠামোগত উন্নতি হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে।

কলকাতার গর্ব, বাংলার শিল্প ঐতিহ্য
কলকাতা-ভিত্তিক এভারেডি ১৯০৫ সাল থেকে ব্যাটারি ও টর্চলাইটে ভারতের বাজারে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। টর্চ, এলইডি লাইট, গৃহস্থালি আলোকসজ্জা—সব ক্ষেত্রেই তারা গ্রাহকের আস্থা অর্জন করেছে। আশ্চর্যের বিষয়, এত বছরের সাফল্যের পরও পশ্চিমবঙ্গে এভারেডির কোনও উৎপাদন কারখানা নেই। তবে সদর দফতর ও গবেষণা-উন্নয়ন (R&D) কেন্দ্র কলকাতাতেই রয়েছে, যা শীঘ্রই আন্তর্জাতিক মানের উৎকর্ষ কেন্দ্রে পরিণত হবে।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
২০০ কোটি টাকার এই বিনিয়োগ জম্মুর অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে—

Advertisements
  • কর্মসংস্থান: শতাধিক স্থানীয় বাসিন্দা সরাসরি এবং শতাধিক মানুষ পরোক্ষভাবে কাজের সুযোগ পাবেন।
  • সহযোগী শিল্পের উন্নতি: পরিবহন, সরবরাহ শৃঙ্খল, ছোট শিল্প ইউনিটগুলির বিকাশ ঘটবে।
  • দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধি: স্থানীয় অর্থনীতির গতি বাড়বে, ভোক্তা ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।

এই প্রকল্প শুধুমাত্র ব্যবসায়িক সম্প্রসারণ নয়, বরং স্থানীয় উন্নয়নের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

রাজনৈতিক তাৎপর্য
৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের পর বিজেপি নেতৃত্ব বারবার বলেছিলেন—এতে কাশ্মীর ভারতের বাকি রাজ্যের মতোই শিল্প বিনিয়োগের সুযোগ পাবে। তৃণমূলের একাংশ এই দাবিকে ‘রাজনৈতিক নাটক’ বলেছিল। কিন্তু কলকাতার এক শীর্ষস্থানীয় সংস্থার এই বিনিয়োগ প্রমাণ করছে যে শিল্পক্ষেত্রে পরিবর্তন বাস্তবেই ঘটছে।

যদিও বিরোধীরা এখনও বলছে—এটি ব্যতিক্রম, সাধারণ শিল্পপতিরা কাশ্মীরে বিনিয়োগে আগ্রহী নন; তবুও এই প্রকল্প নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে।

প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য
এভারেডি কেবল উৎপাদন বাড়াতেই নয়, পরিবেশবান্ধব ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি তৈরিতেও মন দিচ্ছে। কলকাতার R&D কেন্দ্রে নবীন প্রযুক্তি, টেকসই উপকরণ ও শক্তি-দক্ষ পণ্য উদ্ভাবনের কাজ চলছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারেও ভারতের তৈরি ব্যাটারি রপ্তানি করার পরিকল্পনা রয়েছে।

জম্মুতে এভারেডির ২০০ কোটি টাকার অ্যালকালাইন ব্যাটারি কারখানা কেবল এক শিল্পপ্রকল্প নয়—এটি ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের বাস্তব অর্থনৈতিক প্রভাবেরও উদাহরণ। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন দেশীয় উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়বে, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিতর্কের নতুন মাত্রা যোগ হবে। কলকাতার এই ঐতিহ্যবাহী সংস্থা দেখিয়ে দিল—ভূস্বর্গে বিনিয়োগ আর শুধু রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং কার্যকর বাস্তবতা।