ভারত শীঘ্রই অ্যাপলের সমস্ত আইফোন (iPhones) মডেলের উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল হতে চলেছে। এই ভারত-নির্মিত আইফোনগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হবে, যা চীনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই তথ্যটি কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ভারত টেলিকম ২০২৫ ইভেন্টে প্রকাশ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য উত্তেজনার মধ্যে ভারত মোবাইল উৎপাদনের একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। ভারত টেলিকম ২০২৫ ইভেন্টে বক্তৃতা দেওয়ার সময় সিন্ধিয়া জানান, অ্যাপল আগামী বছরগুলিতে তাদের সমস্ত পণ্য এবং মোবাইল ডিভাইস ভারতে উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ভারতে এই ধরনের বিনিয়োগ শুধুমাত্র সদিচ্ছার প্রকাশ নয়, বরং প্রতিটি মূল সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক (OEM) এর জন্য একটি দৃঢ় আর্থিক সিদ্ধান্ত।
ভারতে সমস্ত আইফোন উৎপাদন
সম্প্রতি একটি আয়ের কলের সময় অ্যাপলের সিইও টিম কুক ঘোষণা করেছেন, জুন মাস থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া বেশিরভাগ আইফোন ভারত থেকে রপ্তানি করা হবে, অর্থাৎ এগুলি সম্পূর্ণভাবে ভারতে উৎপাদিত হবে। তবে, বিশ্ব বাজারে উপলব্ধ আইফোনের বেশিরভাগই এখনও চীনে উৎপাদিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও, ভারত-নির্মিত আইফোনগুলি ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় বাজারে পৌঁছতে শুরু করেছে। এই পদক্ষেপ ভারতের উৎপাদন ক্ষমতার উপর অ্যাপলের ক্রমবর্ধমান আস্থাকে প্রতিফলিত করে এবং ভারতকে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে।
আমদানিকারক থেকে শীর্ষ রপ্তানিকারক
ইভেন্টে কেন্দ্রীয় টেলিকম রাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দ্র শেখর পেম্মাসানি ২০১৪ সালে মোবাইল আমদানিকারক থেকে ভারতের শীর্ষ রপ্তানিকারক হিসেবে রূপান্তরের জন্য গর্ব প্রকাশ করেন। ২০১৪ সালে ভারত মাত্র ৬০ লক্ষ মোবাইল ফোন উৎপাদন করত এবং ২১০ কোটি ইউনিট আমদানি করত। কিন্তু ২০২৪ সালে উৎপাদন বেড়ে ৩৩০ কোটি ইউনিটে পৌঁছেছে, যার মধ্যে ৫০ কোটি ইউনিট রপ্তানি করা হয়েছে। এই অসাধারণ সাফল্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের ফল। পেম্মাসানি আরও জানান, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আইফোন উৎপাদনের ১৫ শতাংশ ভারত থেকে আসছে, যা ভারতের প্রযুক্তি খাতে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।
৫জি নেটওয়ার্কের অগ্রগতি
ভারত টেলিকম ২০২৫ ইভেন্টে কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রী সিন্ধিয়া আরও উল্লেখ করেন, ভারতের ৯৯ শতাংশ গ্রামে এখন ৫জি সংযোগ পৌঁছে গেছে। দেশের ৮২ শতাংশ জনগণকে এই নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হ personally, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এই অগ্রগতি সম্পন্ন করতে মোট ৪,৭০,০০০ মোবাইল টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। এই ডিজিটাল হাইওয়ে ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শাসন এবং অর্থনৈতিক সুযোগের দ্বার উন্মোচন করছে। সিন্ধিয়া জোর দিয়ে বলেন, এটি কেবল যোগাযোগের অবকাঠামো নয়, বরং এটি ‘অবকাঠামোর অবকাঠামো’, যা দেশের প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করছে।
অ্যাপলের কৌশলগত পদক্ষেপ
অ্যাপলের এই সিদ্ধান্ত ভারতের উৎপাদন ইকোসিস্টেম এবং নীতিগত পরিবেশের প্রতি ক্রমবর্ধমান আস্থার প্রতিফলন। সিন্ধিয়া জানান, সরকারের প্রোডাকশন-লিঙ্কড ইনসেনটিভ (PLI) স্কিম টেলিকম সরঞ্জাম বাজারে বহুগুণ বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। মাত্র ৪,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগে ৮০,০০০ কোটি টাকার বিক্রয়, ১৬,০০০ কোটি টাকার রপ্তানি এবং ২৫,০০০ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিসংখ্যান ভারতের টেলিকম খাতের অভূতপূর্ব সম্প্রসারণকে তুলে ধরে।
অ্যাপল ভারতে তার উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য টাটা ইলেকট্রনিক্স এবং ফক্সকনের মতো অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে। ফক্সকন একাই মার্চ মাসে ১৩১ কোটি ডলার মূল্যের অ্যাপল ডিভাইস রপ্তানি করেছে, যার মধ্যে আইফোন ১৩, ১৪, ১৬ এবং ১৬ই মডেল রয়েছে। এছাড়াও, অ্যাপল বেঙ্গালুরু, পুনে, দিল্লি-এনসিআর এবং মুম্বাইয়ে চারটি নতুন রিটেল স্টোর খোলার মাধ্যমে ভারতে তার খুচরা ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে।
চীনের উপর নির্ভরতা হ্রাস
অ্যাপলের এই পদক্ষেপ মার্কিন-চীন বাণিজ্য উত্তেজনা এবং শুল্ক সংক্রান্ত অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। টিম কুক জানিয়েছেন, চীন অন্যান্য বাজারের জন্য বেশিরভাগ ডিভাইস উৎপাদন করবে, তবে মার্কিন বাজারের জন্য ভারতই প্রাথমিক উৎস হবে। এটি চীনের উপর অ্যাপলের নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে। তবে, বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতে সম্পূর্ণ উৎপাদন স্থানান্তর এখনও কয়েক বছর সময় নিতে পারে, কারণ ভারতের উৎপাদন ব্যবস্থা এখনও চীন থেকে উপাদান আমদানির উপর নির্ভরশীল।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
অ্যাপলের এই সিদ্ধান্ত ভারতের অর্থনীতির জন্য একটি বড় সুযোগ। এটি কেবল রপ্তানি বাড়াবে না, বরং হাজার হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। ২০২৫ সালের মার্চে শেষ হওয়া আর্থিক বছরে অ্যাপল ভারতে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের আইফোন উৎপাদন করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি ভারতের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের সাফল্যকে তুলে ধরে।
অ্যাপলের সম্পূর্ণ আইফোন উৎপাদন ভারতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত ভারতের প্রযুক্তি ও উৎপাদন খাতের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ভারত টেলিকম ২০২৫ ইভেন্টে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার ঘোষণা এবং টিম কুকের বক্তব্য ভারতের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকে বিশ্ব মঞ্চে তুলে ধরেছে। ৫জি নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ এবং মেক ইন ইন্ডিয়া উদ্যোগের সাফল্য ভারতকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। এই পদক্ষেপ ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্বনির্ভরতার পথে একটি বড় পদক্ষেপ।