রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস লিমিটেড (আরকম) ও সংস্থার প্রোমোটার ডিরেক্টর অনিল ডি. আম্বানিকে “জালিয়াত” হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই)। সংসদে একটি লিখিত উত্তরে অর্থ মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধুরি এই তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ফ্রড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত নির্দেশিকা ও এসবিআই বোর্ড-অনুমোদিত নীতিমালার অধীনে এই শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। বর্তমানে বিষয়টি সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (CBI) কাছে পাঠানো হচ্ছে।
মন্ত্রী জানান, “২০২৫ সালের ২৪ জুন এসবিআই রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে এই জালিয়াতি শ্রেণিবিন্যাসের বিষয়ে রিপোর্ট করেছে এবং বর্তমানে সিবিআইয়ের কাছে অভিযোগ দায়েরের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।”
আরও জানা যায়, ১ জুলাই ২০২৫ তারিখে বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে সংস্থা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের অংশ হিসেবে আরকম-এর রেজোলিউশন প্রফেশনাল জালিয়াতি শ্রেণিবিন্যাস সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে।
প্রায় ৩০০০ কোটি টাকার ব্যাঙ্ক এক্সপোজার:
এসবিআই-এর আরকম অ্যাকাউন্টে ঋণসংক্রান্ত এক্সপোজার বিশাল অঙ্কের। ফান্ড-বেসড ঋণের মধ্যে মূলধন বাবদ বকেয়া রয়েছে ২,২২৭.৬৪ কোটি টাকা (২০১৬ সালের ২৬ আগস্ট থেকে সুদসহ), এছাড়াও ৭৮৬.৫২ কোটি টাকার নন-ফান্ড বেসড ব্যাঙ্ক গ্যারান্টিও রয়েছে বলে মন্ত্রী জানান।
কর্পোরেট ইনসোলভেন্সি প্রক্রিয়ায় আরকম:
উল্লেখযোগ্যভাবে, আরকম বর্তমানে ইনসোলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপ্সি কোড, ২০১৬-এর আওতায় কর্পোরেট ইনসোলভেন্সি রেজোলিউশন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ঋণদাতাদের কমিটি (Committee of Creditors) একটি রেজোলিউশন প্ল্যান অনুমোদন করেছে, যা ২০২০ সালের ৬ মার্চ মুম্বই জাতীয় কোম্পানি আইন ট্রাইব্যুনালে (NCLT) জমা দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত এনসিএলটি-র অনুমোদন মেলেনি।
অনিল আম্বানির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত দেউলিয়া মামলাও:
মন্ত্রী পঙ্কজ চৌধুরি আরও জানান, এসবিআই অনিল ডি. আম্বানির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত দেউলিয়া প্রক্রিয়াও শুরু করেছে, যা বর্তমানে মুম্বই এনসিএলটি-তে বিচারাধীন।
আদালতের নির্দেশে একবার বাতিল হয়েছিল জালিয়াত শ্রেণিবিন্যাস:
এই প্রথম নয়, এর আগেও এসবিআই আরকম ও অনিল আম্বানিকে “জালিয়াত” ঘোষণা করেছিল। ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর তাদের ফ্রড হিসেবে চিহ্নিত করে ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি সিবিআইয়ে অভিযোগও দায়ের করে। কিন্তু ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি দিল্লি হাইকোর্টের এক “স্ট্যাটাস কু” নির্দেশের ফলে সেই অভিযোগ ফেরত পাঠানো হয়।
পরে ২০২৩ সালের ২৭ মার্চ, সুপ্রিম কোর্টের এক রায় (Civil Appeal No. 7300-7307 of 2022 – State Bank of India & Others Vs Rajesh Agarwal & Others) অনুযায়ী, কোনও অ্যাকাউন্টকে ফ্রড হিসেবে ঘোষণার আগে ঋণগ্রহীতাকে নিজের বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দিতে হবে। এই নির্দেশের ভিত্তিতে এসবিআই ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রথম শ্রেণিবিন্যাসটি বাতিল করে দেয়।
নতুনভাবে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ফের শ্রেণিবিন্যাস:
পরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২০২৪ সালের ১৫ জুলাইয়ের সার্কুলারের ভিত্তিতে, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আবারও শ্রেণিবিন্যাস প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং সংস্থাটিকে পুনরায় “জালিয়াত” হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়।
বড় প্রশ্ন: তদন্তে কী উঠে আসবে?
এখন প্রশ্ন উঠছে, সিবিআই তদন্তে এই বিতর্কিত ঋণখেলাপ ও জালিয়াতির মামলায় আর কী কী তথ্য সামনে আসবে? আরকম-এর বিপুল ঋণের অঙ্ক, অনিল আম্বানির ব্যক্তিগত দেউলিয়া মামলা, এনসিএলটি-তে বিচারাধীন প্রক্রিয়া এবং সুপ্রিম কোর্টের নজিরবিহীন হস্তক্ষেপ – সব মিলিয়ে মামলাটি যে বহু স্তরে জটিল তা বলাই বাহুল্য।
অর্থনীতিবিদদের মতে, আরকম ও অনিল আম্বানির বিরুদ্ধে এতদিন পর ফের ‘ফ্রড’ শ্রেণিবিন্যাস ও তদন্তের উদ্যোগ স্পষ্ট করে দেয়, ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় জালিয়াতির বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিতে শুরু করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি। যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বিচারব্যবস্থার হাতেই।
এই মামলার ভবিষ্যৎ পরিণতি কেবলমাত্র আরকম বা অনিল আম্বানির ভাগ্যই নয়, বরং ভারতের কর্পোরেট দায়বদ্ধতা ও ঋণ পুনরুদ্ধার ব্যবস্থার উপরও প্রভাব ফেলতে চলেছে, এমনটাই মত বিশ্লেষকদের।