অন্ধ্রপ্রদেশ (Andhra Pradesh) একটি বড় খবরের মুখে এসেছে। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বিখ্যাত নৌকা পরিবহন ও লজিস্টিক্স কোম্পানি এপিএম টার্মিনালস (একটি মার্সক গ্রুপের অংশ) এর সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশ মেরিটাইম বোর্ড (এপিএমবি) একটি গুরুত্বপূর্ণ মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং (MoU) সই করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে প্রায় ৯,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগের মাধ্যমে রামায়পট্টনম, মাচিলিপট্টনম এবং মুলাপেটা-এর মতো তিনটি নতুন সাগরবন্দর তৈরির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই প্রকল্পটি অন্ধ্রপ্রদেশকে ভারতের একটি প্রধান বাণিজ্যিক গেটওয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে এবং এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতি, চাকরির সুযোগ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংযোগে বিরাট ঝাঁকুনি আসবে।
ঐতিহাসিক সংযোগের পুনর্জন্ম
নেদারল্যান্ডস এবং ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ইতিহাস খুব গভীর। ১৬০৪ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (ভিওসি) ভারতে প্রথম বাণিজ্য শুরু করে, যা মাসুলিপট্টনমে তাদের প্রথম কারখানা স্থাপন করে। আজকের এই চুক্তিটি সেই ঐতিহাসিক সম্পর্কের একটি আধুনিক সংস্করণ বলা যায়। এপিএম টার্মিনালস, যিনি বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে উন্নত নৌকা টার্মিনাল পরিচালনা করে, এবার অন্ধ্রপ্রদেশের তিনটি বন্দরে আধুনিক টার্মিনাল, মাল পরিবহন সুবিধা এবং লজিস্টিক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করবে। এই প্রকল্পটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, বরং পরিবেশগত স্থিতিশীলতার দিকেও মনোযোগ দেবে, যা নেদারল্যান্ডসের স্থিতিশীল নৌকা সেক্টরের একটি বৈশিষ্ট্য।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও চাকরির সুযোগ
এই ৯,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগের ফলে প্রায় ১০,০০০ জনের জন্য সরাসরি ও পরোক্ষ চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এছাড়া, অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্যে বন্দর উন্নয়ন স্থানীয় জিডিপি-এ প্রতি বছর ২-৩% বৃদ্ধি আনতে পারে, যা ২০২৩ সালের জার্নাল অফ ম্যারিটাইম ইকোনমিক্স-এর গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এন. চন্দ্রবাবু নায়ডু এই প্রকল্পটিকে একটি “ডবল ইঞ্জিন” উন্নয়ন হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেখানে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, “এই বন্দরগুলো একটি ইন্টিগ্রেটেড লজিস্টিক্স ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করবে, যা রেল, সড়ক, ভিতরের পানি পথ এবং বিমান চলাচলের মাধ্যমে মাল পরিবহনকে সহজ করবে।”
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গেটওয়ে
অন্ধ্রপ্রদেশের দীর্ঘ সমুদ্রতীর এবং ভৌগোলিক সুবিধা ব্যবহার করে এই বন্দরগুলো ভারতকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে রূপান্তর করতে পারে। এই প্রকল্পটি তেলাঙ্গানা, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক এবং ওড়িশার মতো প্রতিবেশী রাজ্যের ব্যবসার উপর নির্ভরশীলতাকে আরও শক্তিশালী করবে। এপিএম টার্মিনালসের মতো একটি বিশ্বব্যাপী কোম্পানির অংশগ্রহণ অন্ধ্রপ্রদেশকে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বন্দরগুলোর মধ্যে একটি শীর্ষস্থানীয় হতে সাহায্য করবে। ২০২৪ সালে প্রণীত অন্ধ্রপ্রদেশ মেরিটাইম পলিসি-তে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাজ্যটি ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের মেরিটাইম গেটওয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্য রেখেছে, এবং এই চুক্তিটি সেই লক্ষ্যে একটি বড় পদক্ষেপ।
পরিবেশ ও টেকনোলজির সমন্বয়
এপিএম টার্মিনালস ২০৪০ সালের মধ্যে নেট-জিরো লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কাজ করছে, যা এই প্রকল্পে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনা নির্দেশ করে। অন্ধ্রপ্রদেশ সাম্প্রতিক সময়ে কৃষ্ণপট্টনমের কাছে ১৬,০০০ কোটি টাকার গ্রিন হাইড্রোজেন প্রকল্প শুরু করেছে, যা পরিবেশগত স্থিতিশীলতা ও শক্তি উৎপাদনে একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এই দুটি প্রকল্প একসঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশকে একটি স্থিতিশীল এবং আধুনিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
যদিও এই চুক্তিটি উৎসাহজনক, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রকল্পের সময়সূচী, ভূমি অধিগ্রহণ এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমন্বয় প্রকল্পের সফলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে, রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের “ডবল ইঞ্জিন” সহযোগিতা এই বাধাগুলোর মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে।
সারাংশে বলা যায়, নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে এই ৯,০০০ কোটি টাকার চুক্তি অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, বরং ভারতের গ্লোবাল ট্রেডে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করবে। স্থানীয় জনগণের জন্য চাকরি, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার এই সমন্বয় অন্ধ্রপ্রদেশকে ভারতের মানচিত্রে একটি উজ্জ্বল স্থানে রাখবে।