জিএসটি কাউন্সিলের নতুন সংস্কার প্যাকেজ “GST 2.0” ঘোষণার পর থেকে দেশের কর কাঠামোয় বড় পরিবর্তন আসছে। বিশেষত যেসব পণ্যকে “পাপপণ্য” হিসেবে ধরা হয়, তাদের ওপর করের চাপ বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে, দীর্ঘদিনের নীতি অনুযায়ী মদকে এখনো জিএসটির বাইরে রেখেছে কেন্দ্র।
নতুন কাঠামো অনুযায়ী, সিগারেট, তামাকজাত দ্রব্য, গুটখা, পান মশলা ইত্যাদির ওপর এখন থেকে ৪০ শতাংশ হারে জিএসটি ধার্য হবে। আগে এই হার ছিল ২৮ শতাংশ। ফলে এসব পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। সরকারের যুক্তি, এই সিদ্ধান্তের মূল উদ্দেশ্য দুটি—
১. জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে ভোক্তাদের নিরুৎসাহিত করা।
২. রাজস্ব আয় বাড়ানো।
কেন্দ্রের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর প্রকাশিত প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তরে (FAQ) বলা হয়েছে— “এই বিশেষ হার কেবল কিছু নির্দিষ্ট পণ্যেই প্রযোজ্য, প্রধানত পাপপণ্য ও বিলাসপণ্যগুলির ওপর। পূর্বে এগুলির ক্ষেত্রে জিএসটির পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ সেসও ধার্য হত। এখন যেহেতু ক্ষতিপূরণ সেস তুলে দেওয়া হয়েছে, তাই কার্যত সেই কর জিএসটির সাথেই মিশে যাচ্ছে।” অর্থাৎ, কর কাঠামোয় পরিবর্তন হলেও ভোক্তাদের জন্য সামগ্রিক করের চাপ প্রায় অপরিবর্তিত থাকছে।
মদ বা মদ্যপ পানীয়কে বিশেষ কারণে জিএসটির আওতায় আনা হয়নি। তামাকজাত পণ্যের ক্ষেত্রে যেমন সরাসরি কর বৃদ্ধির ঘোষণা হয়েছে, মদের ক্ষেত্রে তার উল্টো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর প্রধান কারণ রাজস্ব আয়ের উৎস।
বিভিন্ন রাজ্যের মোট কর আয়ের ১৫ থেকে ২৫ শতাংশই আসে মদের এক্সাইজ শুল্ক ও ভ্যাট থেকে। ফলে যদি এটিকে জিএসটির আওতায় আনা হয়, তাহলে রাজ্যের স্বাধীন রাজস্ব উৎস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০১৭ সালে জিএসটি চালুর সময় থেকেই এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলেছে, তবে প্রতিবারই মদকে জিএসটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে রাজ্য সরকারগুলি এক্সাইজ শুল্ক, ভ্যাট এবং অতিরিক্ত সারচার্জ বসিয়ে মদের দাম ঠিক করে। জিএসটি ২.০–তেও সেই কাঠামো অপরিবর্তিত থাকছে।
যদিও সরাসরি মদের ওপর জিএসটি নেই, এর চারপাশের নানা পরিষেবা—যেমন বোতলজাতকরণ, প্যাকেজিং, পরিবহন, বিজ্ঞাপন, যন্ত্রপাতি কেনা—এসব ক্ষেত্রে জিএসটি প্রযোজ্য। ফলে কার্যত দ্বৈত কর কাঠামো গড়ে উঠেছে। রাজ্য সরকার কর নেয় মদের বিক্রয়মূল্যে, আর কেন্দ্র পায় এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাপ্লাই চেইনের নানা পরিষেবা থেকে।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্তে দেখা যায়, অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডের মতো দেশে মদ সরাসরি জিএসটির আওতায় আছে। কিন্তু ভারতীয় মডেলে রাজ্যের আর্থিক স্বায়ত্তশাসন অক্ষুণ্ণ রাখতে এটিকে বাইরে রাখা হয়েছে।
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ থেকে জিএসটি ২.০ কার্যকর হলে সাধারণ মানুষ নানা পণ্যের দামে পরিবর্তন দেখতে পাবেন।
সিগারেট, গুটখা, তামাকজাত দ্রব্যের দাম বাড়বে।
চিনি যুক্ত পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের দামও বাড়তে পারে।
তবে মদের দাম নির্ধারিত হবে রাজ্যের কর কাঠামো অনুযায়ী, জিএসটি নয়।
তবে শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত অ্যালকোহল (ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালকোহল) এবার জিএসটির আওতায় আসবে। অর্থাৎ ভোক্তাদের জন্য নয়, কিন্তু শিল্প ব্যবহারকারীদের জন্য কর কাঠামো পাল্টে যাবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই সিদ্ধান্ত আর্থিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক কৌশল—দুটির সমন্বয়। কেন্দ্র রাজস্ব বাড়াতে চাইছে, একই সঙ্গে রাজ্যগুলির প্রধান আয়ের উৎসকে স্পর্শ করতে চাইছে না। রাজনৈতিক দিক থেকেও মদে কর বৃদ্ধি বা কেন্দ্রীকরণ প্রায়ই বিতর্ক সৃষ্টি করে। তাই “হাইব্রিড মডেল”–এর পথেই এগোল জিএসটি কাউন্সিল।
জিএসটি ২.০-র ফলে ভারতের কর কাঠামোতে বড় পরিবর্তন হলেও, মদ্যপ পানীয় রইল রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে পাপপণ্যে কর বাড়ানো হলেও, রাজস্ব সুরক্ষার কারণে মদের কর কাঠামো অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
ফলে আগামী দিনে ভোক্তাদের পকেটে চাপ বাড়বে তামাক ও চিনি মিশ্রিত পণ্যে, কিন্তু মদের দাম নির্ভর করবে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। নতুন এই সংস্কার কার্যত এক নতুন যুগের সূচনা করবে, যেখানে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়ের স্বার্থ সমন্বিতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।