শীত এলেই বাংলার বাজারে একটি পরিচিত দৃশ্য দেখা যায় ফুলকপির দাম (Cauliflower Price) হঠাৎ আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয়া। নভেম্বরের শুরু থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত ফুলকপির দাম ওঠানামা এতটাই অনিয়মিত হয় যে সাধারণ ক্রেতা থেকে শুরু করে পাইকারি বিক্রেতা—সকলেই দিশেহারা হয়ে পড়েন। প্রতি বছর একই ধাক্কা সত্ত্বেও শীতকালে ফুলকপির দাম কেন বাড়ে, কেনই বা মাঝে মাঝে হঠাৎ কমে যায়—এই বাজারের চক্রটি অনেকেই বুঝে ওঠেন না। ২০২৫ সালেও পরিস্থিতি ভিন্ন নয়। এবারও কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, মালদাসহ সব জেলার বাজারেই ফুলকপির দাম শুরুর দিকেই দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে।
বাংলার কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফুলকপির দাম বাড়ার মূল কারণ তিনটি—জলবায়ুর অনিশ্চয়তা, উৎপাদন-চক্রের অসমতা এবং বাজারে অতিরিক্ত চাহিদা। শীতকালীন সবজির মধ্যে ফুলকপির চাহিদা সবচেয়ে বেশি, কারণ এটি ঘরোয়া ও বাণিজ্যিক রান্না—দুই ক্ষেত্রেই অপরিহার্য। বিয়েবাড়ি, হোটেল, রেস্তোরাঁ- সবখানেই শীতকালে ফুলকপির খরচ বাড়ে, ফলে বাজারে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়।
প্রথমত, জলবায়ুর অনিশ্চয়তা দাম বাড়ার অন্যতম বড় কারণ। বৃষ্টি আগেভাগে নামলে বা বর্ষা দেরিতে কাটলে ফুলকপির বীজতলা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আবার নভেম্বর–ডিসেম্বরে তাপমাত্রা বেশি থাকলে ফুল গঠন ঠিক মতো হয় না। এই পরিস্থিতিতে ফুলকপি “buttoning” সমস্যায় পড়ে—অর্থাৎ ফুলের বদলে ডাঁটা বড় হয়ে যায়। দক্ষিণবঙ্গের বহু কৃষকই অক্টোবর মাসে আগাম জাত লাগান, কিন্তু অল্প গরম থাকলে সেই চারা ঠিকমতো ফুল দেয় না। এর ফলে বাজারে আগাম সরবরাহ কমে যায়, আর কম সরবরাহ মানেই দামের ঝড়।
দ্বিতীয় বড় কারণ হলো উৎপাদনের অসমতা। ফুলকপির তিনটি গোষ্ঠী—আগাম, মধ্যম ও বিলম্ব জাত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বেশিরভাগ কৃষকই নভেম্বরেই ফুলকপির চারা রোপণ করেন, কারণ এই সময়টায় জমিতে আর্দ্রতা, শিশির এবং তাপমাত্রা সবই অনুকূলে থাকে। ফলে ডিসেম্বরের শেষে এবং জানুয়ারিতে প্রচুর ফুলকপি বাজারে আসে। কিন্তু নভেম্বরের শুরুতে বা অক্টোবরের শেষে—যখন প্রথম দফার ফুলকপির চাহিদা বেশি—তখন সরবরাহ অল্প থাকে। এই সরবরাহ–চাহিদার অমিল দামের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
তৃতীয়ত, শীতকাল হল ফুলকপির সর্বোচ্চ ভোক্তা-সময়। বাঙালির রান্নাঘরে শীত মানেই ফুলকপির ঘ্রাণ—যা বাজারের চাহিদাকে অত্যন্ত বেড়েই দেয়। এছাড়া বিয়ের মরসুমও শীতেই থাকে, যেখানে সবজি পাইকাররা হাজার কেজি করে ফুলকপি কেনেন। পাইকারদের এই bulk demand বাজারের দামে ঢেউ তোলে। অনেকসময় কৃষকদের খেত থেকে ফুলকপি তোলার আগেই পাইকাররা আগাম বুকিং করে নেন, ফলে সাধারণ বাজারে সরবরাহ আরও কমে যায়।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ন দিক হল পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি। উত্তরবঙ্গ, মুর্শিদাবাদ, মালদা, নদিয়া—এই জেলাগুলিতে ব্যাপক ফুলকপি উৎপাদন হয়। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের কলকাতা শহরের বাজারে সেই ফুলকপি আনতে গেলে ট্রান্সপোর্ট খরচ বাড়ে। ডিজেলের দাম, ঠান্ডা বাড়ায় ট্রাক চলাচলের গতি কমা, রাতের কুয়াশা—সব মিলিয়ে পরিবহন ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটে। এরও দামের ওপর প্রভাব পড়ে।
কৃষকদের দিক থেকে আরও একটি সমস্যা দেখা যায়—পোকার আক্রমণ। শীতে ফুলকপিতে diamondback moth, aphid, flea beetle ইত্যাদির আক্রমণ হয়। এই পোকাগুলি ফুল নষ্ট করে এবং কৃষকের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। অনেক কৃষক আবার যথাযথ Integrated Pest Management (IPM) ব্যবহার করেন না, ফলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। উৎপাদন কমলে সরবরাহ কমবে, আর সরবরাহ কমলেই দাম বাড়বে—এটাই সাধারণ বাজারচক্র।
কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, ফুলকপির বাজার আচরণকে “Seasonal Price Shock” বলা যায়। অর্থাৎ, শীতের শুরুতে দাম বেশি, শীতের মাঝে দাম কম, আর শীতের শেষে আবার দাম আকাশছোঁয়া। এ বছরও সেই একই চক্র দেখা যাচ্ছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এবং জানুয়ারিতে যখন প্রচুর ফুলকপি তুলতে শুরু হবে, তখন বাজারে দাম ২০–৩০ টাকায় নেমে যেতে পারে। কিন্তু নভেম্বরেই দাম ৬০–৮০ টাকা প্রতি পিস হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
সরকারি কৃষি দপ্তর কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছে—অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই আগাম জাত লাগানোর ওপর জোর দিতে। তাপমাত্রা সহনশীল জাত, জৈব সার, সঠিক সেচ ও রোগপোকা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা করলে ফলন বাড়ে এবং বাজারে আগাম সরবরাহ বাড়ানো যায়। এতে দামও স্থিতিশীল থাকে।
সব মিলিয়ে, শীতকালে ফুলকপির দাম বৃদ্ধির পিছনে উৎপাদনচক্র, আবহাওয়া, বাজারের চাহিদা, কৃষি ব্যবস্থাপনা—সবই জরুরি ভূমিকা পালন করে। তাই ২০২৫ সালেও কৃষিসংক্রান্ত এই বাজার ওঠানামা একইভাবে দেখা যাবে বলেই বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস। তবে সরকারি কৃষি নির্দেশনা ও সুশৃঙ্খল চাষের মাধ্যমে কৃষকেরা বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারলে দামের সমস্যা অনেকটাই কমতে পারে।
