২০২৫ সালের শীতকালীন সবজি চাষের জন্য পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) কৃষকদের কাছে একটানা ও সুনির্দিষ্ট একটি কৃষি-পঞ্জিকা থাকা অত্যন্ত জরুরি। প্রতি বছর শীতের শুরুতে হাজারো কৃষক বীজ বপনের সঠিক সময়, চারা তৈরির উপযুক্ত তাপমাত্রা, মাটির প্রস্তুতি, সার ব্যবস্থাপনা, সেচ এবং রোগপোকা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। এ কারণে রাজ্যের কৃষি বিশেষজ্ঞরা ২০২৫ সালের জন্য একটি ‘উইন্টার ভেজিটেবল ক্যালেন্ডার’ প্রস্তুত করেছেন, যা কৃষকদের সময়মতো কাজ করতে সাহায্য করবে এবং ফলন বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
পশ্চিমবঙ্গে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়টাই মূলত শীতকালীন সবজি চাষের সোনালী সময়। এই সময়ের আবহাওয়ায় দিনের তাপমাত্রা কম থাকে, রাতের দিকে শিশির পড়ে এবং বাতাস শুষ্ক থাকে—যা বহু সবজি উৎপাদনের জন্য আদর্শ। বিশেষ করে আলু, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, মটরশুঁটি, ধনেপাতা, লাউ, কুমড়ো, শাকজাতীয়—সবকিছুই ঠিক সময়ে বপন করলে ভালো ফলনের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
২০২৫ সালের ক্যালেন্ডারে কৃষি বিভাগের বিশেষ নজর পড়েছে আগাম জাত, মধ্যম জাত এবং বিলম্ব জাত সবজির বপন ও রোপণের সময়ের ওপর। কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন, অকাল বর্ষণ এবং অনিয়মিত তাপমাত্রার কারণে গত কয়েক বছর ধরেই কৃষকদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এবার বিভাগের লক্ষ্য—“নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাজ”—যাতে প্রতিটি ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।
নভেম্বর মাসেই শুরু করতে হবে বেশ কিছু সবজির বীজতলা। যেমন—বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, ব্রকোলি ইত্যাদির চারা তৈরির জন্য নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বীজতলা তৈরি জরুরি। যারা আগাম জাত লাগাতে চান, তারা অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকেই বীজতলা শুরু করতে পারেন। সাধারণত কোল্ড-হাইজিন মেনে, জৈব সার মিশিয়ে বীজতলা তৈরি করলে চারা সুস্থ ও শক্তিশালী হয়। কৃষি বিভাগের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “আগাম চাষ করলে বাজারে সবজি ওঠার সময় দাম বেশি থাকে। তবে তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে গেলে রোগপোকার আক্রমণও বাড়ে, তাই চারা শক্ত করেই রোপণ করতে হবে।”
আলু, যা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান শীতকালীন ফসল, সেটির বপনের সময়ও নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ২০২৫ সালে আলু বপনের আদর্শ সময় ধরা হচ্ছে ১৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর। আগাম বপন করলে আগাম পোকা (cutworm, aphid) আক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে, আর দেরি করলে ফলন কমে যায়। জেলার ভিত্তিতে আলুর জাতও নির্ধারিত করা হয়েছে—হুগলি, বর্ধমান, নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনায় প্রধানত কুফরি জ্যোতি, কুফরি পাহাড়ি জাত বেশি ফলন দেয়। উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং ও কোচবিহারে স্থানীয় জাতও চাষ করা হয়।
মটরশুঁটির ক্ষেত্রেও সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালের কৃষি-পঞ্জিকায় উল্লেখ করা আছে, নভেম্বরের ১০ তারিখ থেকে ডিসেম্বরের ১৫ তারিখের মধ্যে বপন করা হলে মটরশুঁটির ফলন ভালো হয়। শীতের তীব্রতা বাড়লে ফুল ও শুঁটি গঠনে সমস্যা সৃষ্টি হয়, তাই সঠিক সময়ে বপন করা জরুরি। ধনেপাতা, পুঁইশাক, লালশাক — এসব শাকজাতীয় ফসল নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই চাষ করা যায়।
ফুলকপি ও বাঁধাকপি—এই দুই সবজির জন্য শীতকাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আগাম জাত ফুলকপি অক্টোবর-নভেম্বরে ওঠে, মধ্যম জাত ডিসেম্বর-জানুয়ারি এবং বিলম্ব জাত ফেব্রুয়ারিতে পাওয়া যায়। কিন্তু আবহাওয়ার অনিশ্চয়তায় গত বছর অনেক কৃষকের ফুলকপি ‘buttoning’ সমস্যায় ভুগেছে, অর্থাৎ ফুলের বদলে শুধু ডাঁটা বড় হয়েছে। তাই কৃষি বিশেষজ্ঞরা এই বছর চারা রোপণের সময় নিয়ে বিশেষ সতর্কতা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ঠান্ডা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সঠিক পরিমাণ নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করলে ফুল গঠন ভালো হয়।
টমেটো-চাষিদের ক্ষেত্রেও সময় মেনে চলা জরুরি। টমেটোর বীজতলা তৈরির আদর্শ সময় অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। তবে ২০২৫ সালের ক্যালেন্ডারে জোর দেওয়া হয়েছে তাপমাত্রা-সহনশীল জাত চাষে। কারণ টমেটোর ক্ষেত্রে শীতের মাঝামাঝি সময়ে frost injury বা পাতার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই অপেক্ষাকৃত দেরিতে চারা রোপণ করাই নিরাপদ।
মালদা, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুরের কৃষকেরা লাউ, ঝিঙে, কুমড়ো—এই জাতীয় লতাজাতীয় সবজির বীজ নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে রোপণ করতে পারেন। যদিও এগুলি গ্রীষ্মকালেও চাষ হয়, শীতকালের মিষ্টি রোদ ও কম আর্দ্রতা লতাজাতীয় ফসলকে রোগমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
২০২৫ সালের ক্যালেন্ডারে আরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মাটি পরীক্ষার ওপর। যে কোনও সবজি চাষের আগে মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত, যাতে pH, জৈব কার্বন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশ—এই সব উপাদানের সঠিক মাত্রা জানা যায়। কৃষি বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন—“শীতের সবজি চাষে সার ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বেশি সার দিলে ফলন বাড়ে না, বরং গাছ দুর্বল হয়।”
এছাড়াও রোগপোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য IPM (Integrated Pest Management)–এর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। জৈব কীটনাশক, ফেরোমন ফাঁদ, আলোক ফাঁদ, নিম—এসব ব্যবহারে ফসল নিরাপদ থাকে এবং চাষের খরচও কমে।
সব মিলিয়ে, ২০২৫ সালের শীতকালীন সবজি ক্যালেন্ডার কৃষকদের হাতে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ তুলে ধরেছে—কখন, কোন ফসল, কীভাবে চাষ করলে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া যাবে। কৃষি দপ্তরের আশা, এই ক্যালেন্ডার মেনে চললে রাজ্যের সবজির উৎপাদন বাড়বে, বাজারে দাম স্থিতিশীল থাকবে এবং কৃষকদের আয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হবে।
