টমেটো ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত সবজি। রান্নাঘরে প্রতিদিনের অপরিহার্য এই সবজি হঠাৎ করেই যখন হাতছাড়া দামে পৌঁছে যায়, তখন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে হোটেল-রেস্তরাঁ সবখানেই তার প্রভাব পড়ে। ২০২৫ সালে টমেটোর দাম ফের একবার আকাশছোঁয়া হয়েছে, আর এর পিছনে রয়েছে একাধিক কারণ। চলুন দেখে নেওয়া যাক এ বছরের বাজার পরিস্থিতি ও বিশ্লেষণ।
১. অস্বাভাবিক আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর টমেটো উৎপাদন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার ওঠানামার কারণে।
- দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু—যেখানে দেশের প্রায় ৪০% টমেটো উৎপাদিত হয়—সেই সব রাজ্যে অতিবৃষ্টি ও ফসল নষ্ট হওয়ার ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটেছে। 
- অন্যদিকে, উত্তর ভারতের হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে খরার মতো পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, যা ফসলের ফলনে প্রভাব ফেলেছে। 
ফলে চাহিদা থাকলেও সরবরাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
২. চাষের খরচ বৃদ্ধি
২০২৫ সালে সার, কীটনাশক, পরিবহন ও শ্রম খরচ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। সরকার ভর্তুকি ঘোষণা করলেও চাষিদের মতে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হয়ে গেছে।
- ডিজেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচও দ্বিগুণ হয়েছে। 
- বাজারে পৌঁছানোর আগেই টমেটোর দাম অন্তত ২০–২৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। 
৩. পোকামাকড় ও রোগের প্রভাব
এই মৌসুমে টমেটো ফসলে ভাইরাসজনিত রোগ ও পোকামাকড় আক্রমণও একটি বড় কারণ। ফসলের একটি বড় অংশ বাজারে পৌঁছানোর আগেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষকরা প্রায় ৩০–৪০% পর্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
৪. সরবরাহ চেইনের সমস্যা
টমেটো একটি নাজুক ও সহজে নষ্ট হয়ে যাওয়া পণ্য। সঠিকভাবে ঠান্ডা ঘরে সংরক্ষণ ও দ্রুত পরিবহনের ব্যবস্থা না থাকায় ফসলের অনেকটাই বাজারে পৌঁছানোর আগে নষ্ট হচ্ছে। গ্রাম থেকে শহরে পৌঁছাতে গিয়ে ১০–১৫% টমেটো নষ্ট হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা।
৫. পাইকারি বনাম খুচরা বাজারে দামের ফারাক
বর্তমানে পাইকারি বাজারে টমেটো প্রতি কেজি ৬০–৭০ টাকা হলেও খুচরা বাজারে দাম উঠছে ১০০–১২০ টাকায়। পরিবহন খরচ ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণেই সাধারণ ভোক্তাকে বেশি দাম দিতে হচ্ছে।
৬. ভোক্তাদের উপর প্রভাব
রান্নার অন্যতম অপরিহার্য উপাদান টমেটো, তাই এর দাম বাড়লেই সাধারণ পরিবার থেকে শুরু করে রেস্তরাঁ ও হোটেল শিল্পে বড় প্রভাব পড়ে।
- অনেক পরিবারে টমেটো ব্যবহার অর্ধেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। 
- হোটেল শিল্পে খাবারের দামও বাড়ছে। 
৭. সরকারের পদক্ষেপ
সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।
- ন্যাফেড (NAFED) এর মাধ্যমে হিমঘরে মজুত করা টমেটো বাজারে ছাড়া হচ্ছে। 
- অন্য রাজ্য থেকে টমেটো পরিবহন করে সংকটগ্রস্ত রাজ্যে সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে। 
- আন্তর্জাতিক বাজার থেকেও সীমিত পরিমাণ আমদানির চিন্তাভাবনা চলছে। 
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে কোল্ড স্টোরেজ অবকাঠামো বাড়ানো এবং কৃষকদের জন্য ফসল বিমা প্রকল্পকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
২০২৫ সালের টমেটোর দামের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি শুধু কৃষকদের সমস্যার প্রতিফলন নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তন, চাষের খরচ, ও সরবরাহ চেইনের দুর্বলতাও প্রকাশ করছে। সাধারণ ভোক্তাদের স্বস্তি ফেরাতে শুধু স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ নয়, দীর্ঘমেয়াদী কৃষি সংস্কার ও অবকাঠামো উন্নয়ন অপরিহার্য।



