ভারতের কৃষি ব্যবস্থায় এখন বড়সড় এক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে—অর্গানিক (জৈব) ফার্মিং নাকি কেমিক্যাল ফার্মিং? একদিকে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে দ্রুত ফলন বাড়ানো কেমিক্যাল ফার্মিং, অন্যদিকে প্রাকৃতিক উপায়ে ফসল ফলিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে অর্গানিক ফার্মিং। কৃষকদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—তাঁরা কোন পথে হাঁটবেন?
কেমিক্যাল ফার্মিং: দ্রুত ফলনের চাবিকাঠি
সবুজ বিপ্লবের সময় থেকে ভারতে কেমিক্যাল ফার্মিং ব্যাপক জনপ্রিয় হয়।
- ইউরিয়া, ডিএপি, এমওপি-এর মতো রাসায়নিক সার ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। 
- কীটনাশক ব্যবহারে ফসলকে রোগ-বালাই থেকে রক্ষা করা সহজ হয়েছে। 
- কম সময়ে বেশি উৎপাদন সম্ভব হওয়ায় কৃষকের আয়ও বেড়েছে। 
তবে এর মূল্যও দিতে হয়েছে।
- মাটির প্রাকৃতিক উর্বরতা হ্রাস পেয়েছে। 
- জমিতে বিষাক্ত রাসায়নিকের জমা হওয়ায় পরিবেশ দূষিত হয়েছে। 
- কৃষকের খরচও অনেক বেড়েছে, কারণ সার ও কীটনাশকের দাম প্রতি বছর বাড়ছে। 
অর্গানিক ফার্মিং: স্বাস্থ্য ও পরিবেশের সুরক্ষা
অর্গানিক বা জৈব চাষে ব্যবহার করা হয় প্রাকৃতিক সার (গোবর সার, কম্পোস্ট, ভার্মি কম্পোস্ট) এবং প্রাকৃতিক কীটনাশক (নিম তেল, জীবাণুনাশক মিশ্রণ)।
- ফসলের মান অনেক ভালো হয়, বাজারে দামও বেশি পাওয়া যায়। 
- ভোক্তারা জৈব পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন, কারণ এগুলো স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ। 
- মাটি ও জলের দূষণ কম হয়, জমির দীর্ঘমেয়াদি উর্বরতা বজায় থাকে। 
কিন্তু চ্যালেঞ্জও কম নয়।
- ফলন তুলনামূলক কম হয়। 
- জৈব সার ও প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কীটনাশক তৈরি করতে সময় ও শ্রম বেশি লাগে। 
- বাজারে অর্গানিক পণ্যের প্রমাণীকরণ বা সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া জটিল। 
কৃষকের পছন্দ – বাস্তবতা বনাম আদর্শ
ভারতের অনেক কৃষক এখনও কেমিক্যাল ফার্মিং-এর উপর নির্ভরশীল, কারণ এতে স্বল্প সময়ে ভালো ফলন ও স্থায়ী আয়ের নিশ্চয়তা থাকে। তবে নতুন প্রজন্মের কৃষক, বিশেষ করে শহরকেন্দ্রিক বাজারের কাছাকাছি অঞ্চলে বসবাসকারী কৃষকেরা, অর্গানিক ফার্মিং-এর দিকে ঝুঁকছেন।
- দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, কলকাতার মতো বড় শহরে অর্গানিক সবজির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। 
- সরকারও অর্গানিক ফার্মিং বাড়াতে ভর্তুকি ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিচ্ছে। 
ভবিষ্যৎ কোনদিকে?
কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতে পুরোপুরি কেমিক্যাল ফার্মিং বন্ধ হওয়া বাস্তবসম্মত নয়। তবে ধীরে ধীরে ইন্টিগ্রেটেড ফার্মিং সিস্টেম—যেখানে জৈব ও কেমিক্যাল দুই ধরনের উপকরণের সঠিক ব্যবহার হবে—সেই মডেলই ভবিষ্যতে বেশি কার্যকর হবে।
- এতে ফলনও থাকবে, আবার পরিবেশও সুরক্ষিত হবে। 
- ভোক্তাদের স্বাস্থ্যকর খাদ্যের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। 
ভারতীয় কৃষকের পছন্দ এখন দুই মেরুর মধ্যে দোদুল্যমান। যারা তাত্ক্ষণিক লাভ চান, তাঁরা কেমিক্যাল ফার্মিং বেছে নিচ্ছেন। আর যারা দীর্ঘমেয়াদি টেকসই কৃষি, স্বাস্থ্যকর খাদ্য ও পরিবেশ সুরক্ষার দিকে নজর দিচ্ছেন, তাঁরা অর্গানিক ফার্মিং বেছে নিচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত ভারতের কৃষি হয়তো এই দুইয়ের সমন্বয়ে এগিয়ে যাবে—একটি এমন মডেল, যা একসাথে কৃষকের আয়, ভোক্তার স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করবে।



