বাংলার গ্রামীণ চাষের ছবিতে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে অর্গানিক ফার্মিং বা জৈব চাষাবাদ। দীর্ঘদিন ধরে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল কৃষকরা এখন ধীরে ধীরে ঝুঁকছেন প্রাকৃতিক পদ্ধতির দিকে। এর ফলে যেমন মাটির উর্বরতা বাড়ছে, তেমনি কৃষকরা পাচ্ছেন নতুন আয়ের সুযোগ। বাংলার একাধিক গ্রামে এই পরিবর্তনকে দেখা যাচ্ছে বাস্তবে, যা এখন সাফল্যের গল্পে পরিণত হয়েছে।
নদিয়ার অর্গানিক চাষের জয়যাত্রা
নদিয়ার কৃষক শঙ্কর মণ্ডল একসময় আলু ও ধান চাষে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতেন। কিন্তু খরচ বাড়লেও ফলন আশানুরূপ হচ্ছিল না। ২০১৮ সালে তিনি অর্গানিক পদ্ধতিতে সবজি চাষ শুরু করেন। আজ তাঁর চাষের ব্রকোলি, পালং শাক, টমেটো কলকাতার নামী অর্গানিক মার্কেটে পৌঁছচ্ছে। শঙ্করের কথায়, “আগে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হতাম। এখন অর্গানিক সবজি বিক্রি করে প্রিমিয়াম দাম পাই। গ্রাহকরাও সন্তুষ্ট।”
বাঁকুড়ার নারী কৃষকেদের উদ্যোগ
বাঁকুড়ার কাঁকসায় প্রায় ৩০ জন নারী কৃষক একত্র হয়ে গড়ে তুলেছেন অর্গানিক কৃষক সমবায় সমিতি। তাঁরা গোমূত্র, গোবর, নিমপাতা ও দেশীয় জৈব সার ব্যবহার করে ধান ও ডাল চাষ করছেন। এখন তাঁদের উৎপাদিত শস্য শুধুমাত্র স্থানীয় হাটে নয়, অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও বিক্রি হচ্ছে। সমিতির এক সদস্যা রেখা সাঁতরা বলেন, “অর্গানিক পদ্ধতিতে খরচ কমেছে। মাটি আবার আগের মতো উর্বর হচ্ছে।”
উত্তরবঙ্গের চা বাগানে জৈব সাফল্য
দার্জিলিং ও কালিম্পঙের চা বাগানেও অর্গানিক চাষের বিপ্লব হয়েছে। একাধিক বাগান এখন সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে চা উৎপাদন করছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলা চায়ের দাম বেড়েছে। দার্জিলিংয়ের এক বাগান মালিক বলেন, “বিদেশে জৈব চায়ের চাহিদা অত্যন্ত বেশি। এই কারণে অর্গানিক চাষ আমাদের অর্থনীতির জন্য লাভজনক।”
সরকারের সহায়তা
পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘পরম্পরাগত কৃষি উন্নয়ন যোজনা’ (PKVY) ও ‘মিশন অর্গানিক ভ্যালি’ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্গানিক চাষের ফলে কৃষিপণ্য স্বাস্থ্যকর হচ্ছে এবং পরিবেশও রক্ষা পাচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ ও আশার আলো
অবশ্য সব সাফল্যের মধ্যেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন—
উৎপাদনের প্রথম দিকে ফলন কম হয়।
অর্গানিক সার ও কীটনাশক তৈরিতে সময় লাগে।
বাজারে প্রতিযোগিতা এখনও কঠিন।
তবুও কৃষকরা আশাবাদী। কারণ, শহরের মানুষ এখন স্বাস্থ্য সচেতন। অর্গানিক সবজি, শস্য ও চায়ের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। ফলে কৃষকরা প্রিমিয়াম দাম পাচ্ছেন।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলার গ্রামীণ চাষে এক সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয়েছে। নদিয়া, বাঁকুড়া থেকে দার্জিলিং—অর্গানিক চাষ শুধু কৃষকদের আর্থিক সুরক্ষা দিচ্ছে না, বরং আগামী প্রজন্মের জন্য মাটিকে রক্ষা করছে। বাংলার এই সাফল্যের গল্প ভারতের অন্যান্য রাজ্যের কাছেও উদাহরণ হয়ে উঠছে।