HomeBusinessAgricultureআলু–সর্ষে–সবজি চাষে উত্তরবঙ্গে শুরু জমি তৈরির ব্যস্ততা

আলু–সর্ষে–সবজি চাষে উত্তরবঙ্গে শুরু জমি তৈরির ব্যস্ততা

জল সংরক্ষণ থেকে আগাছা দমন—শীতের আগে ব্যস্ত কৃষিজমি

- Advertisement -

উত্তরবঙ্গের কৃষিজমি (North Bengal farming) যখন শীতের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছায়, তখনই শুরু হয় বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি শীতকালীন ফসলের জন্য জমি তৈরি। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর—এই বিস্তৃত অঞ্চলে শীতকালের কৃষিকাজ শুধু মরসুমি চাষ নয়, বরং বহু পরিবারের প্রধান জীবিকা ও আয়ের উৎস। তাই শীতের কৃষি মরসুম শুরুর আগে জমি ঠিকভাবে প্রস্তুত করা উত্তরবঙ্গের কৃষকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চলতি বছ এই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকেই কৃষকেরা মাঠে ব্যস্ত। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে শীতের আমেজ কিছুটা দেরিতে এলেও কৃষকরা তাদের পুরনো অভ্যাস ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে জমি প্রস্তুত করতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে আলু, সর্ষে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, মটরশুঁটি এবং শাকসবজির জন্য জমি যত ভালোভাবে প্রস্তুত হবে, ফসল ততই ভালো হবে—এ ধারণাটিই উত্তরবঙ্গের কৃষকদের বছরের পর বছর অভিজ্ঞতা দিয়ে শিখিয়েছে।

   

উত্তরবঙ্গের মাটি মূলত ইনসেপ্টিসল ও এন্টিসোল ধরনের, যা শীতকালীন সবজি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে মাটির গঠন অঞ্চলভেদে আলাদা—দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি অঞ্চল পাহাড়ি দোঁআশ মাটি, কোচবিহার ও জলপাইগুড়িতে বেলে-দোঁআশ, আবার দিনাজপুর অঞ্চলে বেশিরভাগই দোআঁশ বা ভারী মাটি। তাই জমি প্রস্তুতি প্রতিটি অঞ্চলে ভিন্ন হলেও সাধারণভাবে কিছু ধাপ সবার ক্ষেত্রেই অপরিহার্য।

প্রথম ধাপ হলো মাটি পরিষ্কার ও আগাছা দমন। বর্ষার পরে খেতে নানা আগাছা জন্মে, যা শীতকালীন ফসলের পুষ্টি ছিনিয়ে নিতে পারে। কৃষকেরা তাই জমি থেকে আগাছা তুলে শুকাতে দেন, যাতে পরে সেগুলো জৈবসার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। অনেকেই এই সময় হালকা চাষ দিয়ে মাটির উপরের স্তর উল্টে দেন, যাতে আগাছার বীজ নষ্ট হয়।

পরের ধাপ হলো মাটি চাষ ও দোআঁশ করা। উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা সাধারণত প্রথমে ট্র্যাক্টর বা হাল দিয়ে জমি গভীরভাবে চাষ করেন, যাতে বর্ষার পরে জমিতে যে শক্ত স্তর তৈরি হয়, তা ভেঙে নরম হয়। দ্বিতীয়বার চাষ করে মাটি আরও ঝুরঝুরে করা হয়। কারণ ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু, শাকসবজি—এগুলোর জন্য নরম, ঝুরঝুরে মাটি গাছের মূল বিস্তার ও পুষ্টি গ্রহণে সহায়ক।

যেসব এলাকায় কাদামাটির আধিক্য, সেসব জায়গায় কৃষকেরা ধান কাটার পরে খড় পুড়িয়ে মাটি হালকা করেন—যদিও এটি পরিবেশগত কারণে নিরুৎসাহিত। অনেকেই এখন বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে খড় কেটে নিকাশির সঙ্গে মিশিয়ে জৈবসারের জোগান বাড়ান। এতে মাটির গঠন উন্নত হয় এবং জৈব কার্বন বাড়ে।

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো জৈবসার ও গোবর খামারের ব্যবহার। উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা শীতকালের জমিতে চাষ শুরুর আগে প্রতি বিঘায় ১০–১২ কোয়িন্টাল পচা গোবর, সার বা কম্পোস্ট ব্যবহার করেন। এতে মাটির উর্বরতা পুনঃস্থাপিত হয়। দার্জিলিংয়ের অনেক কৃষক ভের্মিকম্পোস্টের দিকে ঝুঁকছেন, কারণ এটি মাটির গঠন উন্নত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

এরপর আসে মাটি পরীক্ষার গুরুত্ব। কৃষি দপ্তর উত্তরবঙ্গের প্রতিটি ব্লকে মাটি পরীক্ষার কেন্দ্র চালু করেছে। যেখানে pH, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। মাটির pH যদি ৫.৫–৬.৫ এর মধ্যে থাকে, তা শীতকালীন সবজির জন্য আদর্শ। দিনাজপুর অঞ্চলের মাটিতে pH কম থাকে, তাই কৃষকেরা চুন ব্যবহার করে pH সমতা আনার চেষ্টা করেন।

এরপর জমিতে নির্দিষ্ট ফসল অনুযায়ী বেড বা কাণ্ড তৈরি করা হয়। আলু চাষ হলে উঁচু কাণ্ড করা হয়, যাতে জল জমে না থাকে। ফুলকপি ও বাঁধাকপির জন্য ১.৫ ফুট থেকে ২ ফুট দূরত্বে বেড তৈরি করা হয়। যেসব জায়গায় শীতে কুয়াশা বেশি, যেমন জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিংয়ের নিচু অঞ্চল—সেখানে কৃষকেরা স্মার্ট ড্রেনেজ ব্যবস্থা করেন, যাতে জলাবদ্ধতা না হয়।

উত্তরবঙ্গের শীতকালীন ভূমি প্রস্তুতির বড় অংশ জুড়ে থাকে সেচ ও জল সংরক্ষণ। শীতকালে বৃষ্টি নেই, তাই কৃষকেরা অনেকেই পুকুর, শ্যালো টিউবওয়েল, পাম্প সেট দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করেন। আলু ও মটরশুঁটির মতো ফসলে প্রথম ২০ দিনের সেচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই জমি প্রস্তুতের সময়ই নিকাশি লাইন ঠিক করা হয়।

এ সময় কৃষকেরা রোগপোকা প্রতিরোধের প্রাথমিক ব্যবস্থা নেন। বীজ শোধন করা, নিম-খোল ছড়ানো, ট্র্যাপ স্থাপন করা—এসবেই গাছ বড় হওয়ার পরে রোগ কম দেখা দেয়। বিশেষ করে বগা পোকা, মিলিবাগ, এফিড—এগুলির আক্রমণ উত্তরবঙ্গের শীতকালে বেশি হয়। তাই কৃষকেরা আগাম ব্যবস্থা নেন।

পাহাড়ি এলাকায়, বিশেষ করে দার্জিলিংয়ের টেরেস ফার্মিং অঞ্চলে কৃষকেরা জলধারণ ক্ষমতা বাড়াতে জমিতে মাল্চিং করেন। এতে মাটি শুকিয়ে যায় না এবং রাতের শীত থেকে গাছ বাঁচে।

সব মিলিয়ে, উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা শীতকালীন জমি প্রস্তুতিকে যুদ্ধের মতো গুরুত্ব দেন—কারণ এটাই বছরের সবচেয়ে বেশি লাভজনক মরসুম। মাটি ঝুরঝুরে করা থেকে সার ব্যবস্থাপনা, সেচ থেকে আগাম রোগ প্রতিরোধ—সবকিছুই যত যত্নে করা হবে, শীতকালীন ফসলের ফলন ততই ভালো হবে।

- Advertisement -
এই সংক্রান্ত আরও খবর
- Advertisment -

Most Popular