ভারতের কৃষিক্ষেত্র আজ এক বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। জনসংখ্যা বাড়ছে দ্রুত, অথচ চাষযোগ্য জমি ক্রমশ কমছে। দেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের হাতে এক একরেরও কম জমি থাকে। এত অল্প জমিতে সংসার চালানোই যেখানে দুঃসাধ্য, সেখানে বড় মুনাফার কথা ভাবাই কঠিন। কিন্তু নতুন কৃষি পদ্ধতি মাল্টি-লেয়ার ফার্মিং আজ অনেক কৃষকের জীবন বদলে দিচ্ছে। এই চাষ পদ্ধতিতে একই জমি থেকে বছরে একাধিক ফসল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে, আর আয় বেড়ে যাচ্ছে বহু গুণ।
মাল্টি-লেয়ার ফার্মিং কী?
প্রচলিত পদ্ধতিতে এক জমিতে একবারে একটি ফসলই ফলানো হয়। ফলে জমির অনেকটা অংশ খালি পড়ে থাকে। মাল্টি-লেয়ার ফার্মিং সেই অপচয় রোধ করে। এই পদ্ধতিতে জমিকে একটি বহু-তলার বাড়ির মতো কল্পনা করা হয়।
মাটির নিচে: কচু বা হলুদের মতো শিকড়জাত ফসল।
মাটির স্তরে: আলু, আদা বা ডালশস্য।
মধ্য স্তরে: কলা, পেঁপে বা মাঝারি উচ্চতার গাছ।
সবচেয়ে ওপরে: নারকেল, সুপারি বা অন্যান্য উঁচু গাছ।
চুড়োয়: লাউ, করলা বা শশার মতো লতানো গাছ, যা ঝাঁপির মতো ছাউনি তৈরি করে।
এভাবে একটি জমির প্রতিটি স্তর কাজে লাগিয়ে কৃষকরা একসঙ্গে একাধিক ফসল ফলাতে পারেন।
কেরলের বিজুর সাফল্য

কেরলের কন্নুর জেলার কৃষক বিজু নারায়ণন আজ এই মডেলের প্রতীক। আগে তিনি রাবার চাষ করতেন। কিন্তু তাতে আয় কমছিল। পরে তিনি মাল্টি-লেয়ার ফার্মিং গ্রহণ করেন। এখন তাঁর জমিতে একসঙ্গে রয়েছে—
নারকেল (৪৫ ফুট)
মাংগোস্টিন (২৫ ফুট)
গোলমরিচ (১৫ ফুট)
কলা (১০ ফুট)
আদা ও কচু (২–৫ ফুট)
এই উল্লম্ব বিন্যাসে প্রতিটি ফসল নিজের মতো করে সূর্যালোক পায়। ফলে এক জমি থেকেই একসঙ্গে চার-পাঁচটি ফসল ওঠে। তাঁর আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে বছরে প্রতি একরে ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। বিজুর ভাষায়, “আজ আমি রাজা বলে মনে করি নিজেকে।”
মাল্টি-লেয়ার ফার্মিংয়ের সুবিধা
আয় বহুগুণ বৃদ্ধি: একই জমি থেকে ২–৩ গুণ আয় সম্ভব।
খাদ্য নিরাপত্তা: সারা বছর সবজি, ফল, ডাল, কন্দজাতীয় ফসল মেলে।
চাকরির সুযোগ: ফসল তোলার সময় আলাদা হওয়ায় প্রায় সারা বছরই কর্মসংস্থান তৈরি হয়।
জল সাশ্রয়: ওপরে লতানো ফসলের ছায়ায় মাটির জলীয় বাষ্পীভবন কমে।
টেকসই কৃষি: রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়োজন কমে, পরিবেশও সুরক্ষিত থাকে।
কেন জরুরি এই পদ্ধতি
ভারতের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন। জলবায়ু পরিবর্তন, অনিয়মিত বৃষ্টি, এবং জমির সীমাবদ্ধতার কারণে তাঁদের আয় অনিশ্চিত। মাল্টি-লেয়ার ফার্মিং সেই সংকট থেকে এক বাস্তবসম্মত সমাধান। এটি শুধু চাষের পদ্ধতি নয়, বরং একটি বেঁচে থাকার কৌশল।
যেখানে জমি প্রতিদিন কমছে, সেখানে প্রতিটি ইঞ্চিকে কাজে লাগানোই ভবিষ্যতের পথ। মাল্টি-লেয়ার ফার্মিং সেই শিক্ষাই দিচ্ছে। বিজুর মতো আরও অনেক কৃষক আজ দেখাচ্ছেন, সঠিক পরিকল্পনা ও পরিশ্রমে এক একর জমি থেকেও সমৃদ্ধি আসতে পারে। কৃষির এই বহুতল ভাবনা আগামী দিনে দেশের ক্ষুদ্র কৃষকদের কাছে আশার আলো হয়ে উঠতে পারে।

