দামপতনে চরম হতাশায় পেঁয়াজের ‘শবযাত্রা’ কৃষকদের

madhya-pradesh-farmers-funeral-for-onions-as-prices-crash

মধ্যপ্রদেশের মান্দসৌর জেলার ধমনর গ্রামে কৃষকরা এক অভিনব ও হৃদয়বিদারক প্রতিবাদের পথ বেছে নিলেন। বাজারে পেঁয়াজের দাম (Onion Prices) ধস নামায় উৎপাদন খরচের সামান্য অংশটুকুও উদ্ধার করতে না পেরে কৃষকরা পেঁয়াজের ‘শেষকৃত্য’ বা প্রতীকী শবযাত্রা আয়োজন করেন।

Advertisements

ফুলে সাজানো একটি অর্থি, তাতে রাখা পেঁয়াজের বস্তা, চার পাশে ব্যান্ড-বাজনার তালে শোকযাত্রা—সব মিলিয়ে দৃশ্যটি যেন বাস্তব কোনও মৃত্যুশোকের অনুষ্ঠানের মতোই। গ্রামের শ্মশানঘাটে গিয়ে সম্পন্ন হয় এই প্রতীকী ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’।

   

🔻 “পেঁয়াজ আমাদের সন্তানের মতো” — কৃষকদের আর্তি

মালওয়া–নিমাড় অঞ্চল, যা দেশের অন্যতম বৃহৎ পেঁয়াজ উৎপাদক অঞ্চল, সেখানে এখন কৃষকদের হতাশা তুঙ্গে।

মণ্ডিতে পেঁয়াজের দাম এখন কেজিপ্রতি মাত্র ১ থেকে ১০ টাকা। অনেক ক্ষেত্রে দাম দাঁড়িয়েছে ১–২ টাকা প্রতি কেজি। অথচ উৎপাদন খরচই কেজি প্রতি ১০–১২ টাকা, তাতে পরিবহন ও শ্রমের খরচ যোগ হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়ছে।

এই পরিস্থিতির প্রতিবাদ করতে গিয়েই কৃষক বদ্রি লাল ধাধাক বলেন—

“ন্যায্য দাম না পেলে আমরা কীভাবে বাঁচব? এত খরচ করার পর যদি মাজরি দামও না পাই, তাহলে আমরা কোথায় যাব? এই শবযাত্রা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য।”

আরেক কৃষক দেবীলাল বিশওকর্মা বলেন—

“পেঁয়াজ আমাদের সন্তানের মতো। দ্বিতীয় ফসল অতিবৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে। এখন যে পেঁয়াজ বাঁচল, তা মরে গেল বাজারে। তাই আমরা শেষকৃত্য করলাম। সরকার যে দাম দিচ্ছে, তাতে খরচটুকুও উঠছে না।”

🔻 ২৫% এক্সপোর্ট ডিউটি: কৃষকদের ক্ষোভের মূল কারণ

কৃষকদের দাবি, কেন্দ্রীয় সরকারের আরোপিত ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক ভারতীয় পেঁয়াজকে আন্তর্জাতিক বাজারে একেবারে অপ্রতিযোগিতামূলক করে তুলেছে।

ফলে—

  • পেঁয়াজ রপ্তানি কমে গেছে

  • দেশের ভেতর স্টক জমে রয়েছে

  • এবং মণ্ডিগুলোতে ব্যাপকভাবে দাম পড়ে গেছে

তাদের বক্তব্য, কেন্দ্রের কাছে বহুবার আবেদন করা সত্ত্বেও রপ্তানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান বর্তমানে দেশের কৃষিমন্ত্রী। তাই কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বাড়ছে।

🔻 প্রশাসনকে স্মারকলিপি, তহশিলদারের সঙ্গে বৈঠক

শোকযাত্রার পর কৃষকরা তহশিলদার রোহিত সিং রাজপুতকে স্মারকলিপি দেন। রাজপুত জানান—

“কৃষকরা পেঁয়াজের ন্যূনতম দাম বৃদ্ধির দাবি তুলেছেন। তারা চায় সরকার যেন সমর্থনমূল্যে (MSP) পেঁয়াজ কেনা শুরু করে। স্মারকলিপি কलेक্টরকে পাঠানো হবে এবং সরকারকে জানানো হবে।”

তিনি আরও বলেন যে কিছু কৃষক প্রতীকী অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও সম্পন্ন করেছেন, যা পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে।

🔻 মান্দসৌর: কৃষক আন্দোলনের ঐতিহাসিক কেন্দ্র

এলাকাটি কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত পরিচিত। ২০১৭ সালে মান্দসৌরে পুলিশের গুলিতে ছয় কৃষকের মৃত্যুর পর সারা দেশে কৃষি আন্দোলনের তীব্রতা বেড়ে যায়। সেই থেকেই এই জেলা কৃষকদের ক্ষোভ ও আন্দোলনের এক প্রতীকী কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

এই পটভূমিকায় বর্তমান পেঁয়াজ সংকট আবারও সেই ক্ষতকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে।

Advertisements

🔻 “শবযাত্রা শুধু শুরু” — আন্দোলনের হুঁশিয়ারি

কৃষকরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যদি—

  • এক্সপোর্ট ডিউটি প্রত্যাহার না করা হয়

  • এবং ন্যায্য দাম নিশ্চিত না করা হয়

তাহলে তারা অঞ্চলে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করবেন। এই প্রতিবাদ কেবল প্রথম ধাপ।

কৃষকদের ভাষায়—

“পেঁয়াজের শবযাত্রা আজ হয়েছে। কাল যদি দাম না বাড়ে, তাহলে রাস্তা অবরোধ থেকে বিশাল আন্দোলন—সবই হবে।”

🔻 কৃষকদের বিপর্যয়ের সামাজিক-অর্থনৈতিক চিত্র

মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাত—পেঁয়াজ উৎপাদনকারী রাজ্যগুলির কৃষকরা বছরের পর বছর দামের অস্থিরতায় জর্জরিত। কয়েক বছর আগেও ১০০ টাকার ওপর দামে পেঁয়াজ বিক্রি হওয়ায় সাধারণ মানুষ ভুগেছেন। এবার বিপরীত দিকে চরম পতন হয়েছে।

এই দামের ওঠানামার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী—

  • উৎপাদক কৃষকরা

  • তাদের পরিবার

  • এবং কৃষি শ্রমিকরা

পেঁয়াজ চাষে প্রচুর শ্রম, সার, জল ও পরিবহনের খরচ লাগে। কিন্তু দাম যখন কেজি প্রতি ২ টাকা, তখন সেই খরচের সামান্য অংশও ফিরে আসে না।

ধমনর গ্রামের কৃষকদের প্রতীকী পেঁয়াজের ‘শেষকৃত্য’ কেবল একটি প্রতিবাদ নয়—এটি ভারতের কৃষি সংকটের গভীর অসহায়তার প্রতিচ্ছবি।

দেশের অন্যতম বৃহৎ পেঁয়াজ উৎপাদক অঞ্চলের কৃষকরা যখন তাদের ফসলের শবযাত্রা বের করতে বাধ্য হন, তখন তা শুধু অর্থনৈতিক সমস্যাই নয়, সরকারের কৃষিনীতি, বাজারব্যবস্থা ও রপ্তানি নীতিরও বড় ব্যর্থতা তুলে ধরে।

কৃষকদের দাবি—ন্যায্য দামই তাদের একমাত্র বাঁচার রাস্তা।

এখন দেখার বিষয়, সরকার তাদের এই শোক ও ক্ষোভের সুর কত দ্রুত শোনে এবং বাস্তবে কোনও সমাধান আনে কিনা।