পশ্চিমবঙ্গের ছোট ও প্রান্তিক কৃষকের জন্য কম খরচে সুরক্ষিত চাষ (protected cultivation) এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। জলবায়ুর অনিশ্চয়তা, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, তাপমাত্রার হঠাৎ পরিবর্তন—সব মিলিয়ে খোলা মাঠে চাষ ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে কৃষি বিশেষজ্ঞরা এখন যে প্রযুক্তিটির ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন, তা হলো কম খরচের পলিহাউস (Polyhouse Farming), যা ছোট ও মাঝারি কৃষকের নাগালের মধ্যে এবং কম খরচে উচ্চ লাভ নিশ্চিত করতে সক্ষম।
আগামীতেও পশ্চিমবঙ্গ কৃষি দপ্তর এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ছোট কৃষকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের কম খরচের পলিহাউস মডেল সুপারিশ করেছে। এগুলি ব্যবহার করলে ৩৬৫ দিন সবজি, ফুল, নার্সারি চারা, ক্যাপসিকাম, শসা, টমেটো এবং ফলমূল চাষ করা সম্ভব। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কম খরচের পলিহাউস তৈরি করতে সাধারণত বাঁশ, সস্তা GI পাইপ, UV-stabilized প্লাস্টিক শিট, নাইলন রোপ ও নেট ব্যবহার হয়। এর ফলে পুরো স্ট্রাকচারটি শক্ত, টেকসই এবং সাশ্রয়ী হয়।
পলিহাউস আসলে একটি ছোট প্লাস্টিক-কভারড ঘর, যেখানে গাছকে বৃষ্টি, শিলা, পোকামাকড়, অতিরিক্ত রোদ বা ঠান্ডা—সবকিছু থেকেই সুরক্ষা দেওয়া হয়। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে থাকা বলে গাছের বৃদ্ধি স্বাভাবিক থাকে এবং খোলা মাঠের তুলনায় ২–৩ গুণ বেশি ফলন পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের মতো আর্দ্র ও বৃষ্টিপ্রবণ রাজ্যে পলিহাউস চাষ সত্যিই গেম-চেঞ্জার হতে পারে।
প্রথম যে মডেলটি ছোট কৃষকদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী, সেটি হলো বাঁশের লো-কস্ট পলিহাউস। এই মডেলে GI পাইপের বদলে শক্ত মানের বাঁশ ব্যবহার করা হয়। খরচ কম পড়লেও কাঠামো অত্যন্ত স্থির এবং টেকসই হয়। ৪০০–৬০০ বর্গফুটের একটি ছোট পলিহাউস তৈরির খরচ পড়ে আনুমানিক ৩০,০০০–৪৫,000 টাকা। অনেক কৃষক নিজেরাই শ্রম দিয়ে খরচ আরও কমিয়ে আনেন। বাঁশ কাঠামো তৈরি করে UV শিট দিয়ে কভার করলে একটি সাধারণ পলিহাউস দাঁড়িয়ে যায়, যেটা ৩–৪ বছর টেকসই থাকে।
দ্বিতীয় জনপ্রিয় মডেল হলো GI pipe-based low-cost polyhouse। বাঁশের তুলনায় এর খরচ বেশি হলেও টেকসইতা ও স্থায়িত্ব অনেক ভালো। ঝড়-বৃষ্টি বা শিলাবৃষ্টি—কোনোটাতেই কাঠামো সহজে ভাঙে না। GI পাইপের ফ্রেম, ২০০ মাইক্রন UV শিট এবং সাইড নেটিং দিয়ে এমন একটি পলিহাউস তৈরি করলে টমেটো, ক্যাপসিকাম, শসা বা উচ্চমূল্যের সবজি ১২ মাস সফলভাবে চাষ করা যায়। এর খরচ ৮০,০০০–১,২০,০০০ টাকার মধ্যে হলেও, প্রথম বছরেই উৎপাদন বাড়ার কারণে বিনিয়োগ তুলে ফেলা সম্ভব।
তৃতীয় মডেলটি হলো Tunnel Polyhouse, যা খুব ছোট কৃষকদের জন্য আদর্শ। এটি মূলত বাঁশ বা হালকা পাইপ দিয়ে তৈরি একটি লম্বা, নীচু টানেল, যার ওপর UV শিট টানা থাকে। এটি মূলত লেটুস, ধনেপাতা, ক্যাপসিকাম, শসা বা বিভিন্ন রকম চারা উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। খরচ অত্যন্ত কম—প্রতি ১০০০ বর্গফুটে ১০,০০০–১৫,০০০ টাকা। কৃষি দপ্তরের মতে, যারা প্রথমবার পলিহাউস চাষ শুরু করতে চান, তাঁদের জন্য টানেল পলিহাউস উপযুক্ত।
এই বছর কৃষি দপ্তর জোর দিচ্ছে পলিনেট হাউস (Shade Net House)–এর ওপরও। এটি পুরোপুরি প্লাস্টিকের নয়, বরং নেট দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। আলোর তীব্রতা ৫০%–৬০% কমে যায়—যা নার্সারি গাছ, ফুলচাষ এবং পাতাকপি/বাঁধাকপির চারা তৈরির জন্য খুবই উপযোগী। এই ধরনের নেট হাউস তুলনামূলকভাবে সস্তা—৪০,০০০ থেকে ৬০,০০০ টাকায় তৈরি করা যায়।
পলিহাউসের সব মডেলের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো—পানি সাশ্রয়। ড্রিপ সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে পানি ৬০–৭০% কম লাগে। আর মাইক্রো পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত থাকায় রোগপোকার আক্রমণও অনেক কম হয়। ফলে রাসায়নিক কীটনাশক কম ব্যবহার করতে হয়, খরচ কমে যায়, আর উৎপাদনের মানও উন্নত হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পলিহাউস চাষে ফলন বৃদ্ধি ৩০–২০০% পর্যন্ত হতে পারে। বিশেষ করে টমেটো, ক্যাপসিকাম, শসা, বেগুন, স্ট্রবেরি এবং ফুল চাষে পলিহাউসের ফলন খোলা মাঠের তুলনায় তিন গুণ পর্যন্ত বেশি দেখা গেছে। ফলে ছোট কৃষকের আয় অনেকটাই বাড়ে।
একইসঙ্গে, পলিহাউস চাষে মাল্টিপল ক্রপিং সম্ভব। অর্থাৎ একই পলিহাউসে বছরে তিন থেকে চারবার ফসল নেওয়া যায়। শীতকালে শসা–টমেটো–ক্যাপসিকাম, গরমকালে লাউ,ঝিঙে,ঢেঁড়স এভাবে বারো মাস বিভিন্ন ফসল চাষ করে কৃষক বাড়তি আয় করতে পারেন।
সরকারি ভর্তুকিও একটি বড় সুবিধা। পশ্চিমবঙ্গ কৃষি দপ্তর এবং PMKSY স্কিমের আওতায় পলিহাউস নির্মাণে ৫০%–৬৫% পর্যন্ত অনুদান পাওয়া যায়। ফলে বাস্তব খরচ আরও কমে যায়।
সব মিলিয়ে, কম খরচের পলিহাউস চাষ ছোট কৃষকদের জন্য শুধু লাভজনক নয়, বরং অত্যাবশ্যক হয়ে উঠছে। জলবায়ুর চরম পরিবর্তন, বাজার দামের ওঠানামা এবং খোলা মাঠে ফসলের ঝুঁকি—সবকিছুর সমাধান হিসাবে পলিহাউস চাষ আগামী দিনে আরও জনপ্রিয় হবে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস।
