কলকাতা, ৪ নভেম্বর: একসময় বাংলার গ্রামাঞ্চলে দেশজ ধান ও মাছের সুবাস ছিল প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু বিগত কয়েক দশকের ‘হাইব্রিড যুগে’ সেই ঐতিহ্য অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছিল। এবার পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও কৃষিবিজ্ঞানীরা একসঙ্গে উদ্যোগ নিয়েছেন — রাজ্যের গ্রামীণ কৃষিক্ষেত্রে দেশজ ধান ও স্থানীয় মাছের জাত পুনরুদ্ধারের জন্য এক জীববৈচিত্র্য অভিযান শুরু হয়েছে।
এই উদ্যোগকে বলা হচ্ছে “Biodiversity Revival Mission – Bengal 2025”, যার লক্ষ্য হলো স্থানীয় প্রজাতির সংরক্ষণ, টেকসই কৃষি উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
🌱 দেশজ ধানের ফেরা: মাটির গন্ধে ভরপুর গল্প
একসময় বাংলার মাঠে ৫,০০০-রও বেশি দেশজ ধান জাত পাওয়া যেত। কিন্তু এখন সেই সংখ্যাটা নেমে এসেছে ৫০০-রও নিচে।
তবুও নতুন আশা জাগাচ্ছে সরকারি প্রকল্প — কৃষি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২4-25 সালে ৭০টিরও বেশি প্রাচীন ধান জাত যেমন ‘কালো মুগুর’, ‘কাতারিভোগ’, ‘কামিনী’, ‘ঝিঙে ধান’, ও ‘রাধাতিলক’ আবারও চাষে ফিরছে।
রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ও বীরভূম জেলায় কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে দেশজ বীজ ব্যবহার করতে।
একজন কৃষক, সুদেব পাত্র (পুরুলিয়া) বলেন —
“দেশজ ধান মাটির সঙ্গে মানিয়ে নেয়, রাসায়নিক সার লাগে না। খরার সময়েও টিকে থাকে। আমরা এখন আবার ‘কালো মুগুর’ চাষ শুরু করেছি।”
কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, এই ধান জাতগুলির প্রাকৃতিক সহনশীলতা জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
🐟 স্থানীয় মাছের জাত সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ
বাংলার জলাশয়ে একসময় রাজত্ব করত দেশি প্রজাতির মাছ — যেমন পাবদা, মাগুর, শিং, তেলাপিয়া, পুঁটি, কৈ ও কাঁচকি। কিন্তু অতিরিক্ত বিদেশি মাছ যেমন থাই পাঙাস, ভিয়েতনামী ক্যাটফিশ ও বিদেশি কার্প আসায় স্থানীয় মাছের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছিল।
এখন রাজ্য মৎস্য দপ্তর ‘Indigenous Fish Rejuvenation Drive’ নামে এক বিশেষ প্রকল্প চালু করেছে। এতে প্রায় ২০টি দেশজ মাছের জাত সংরক্ষণ ও প্রজনন করা হচ্ছে।
রাজ্য মৎস্য দপ্তরের এক আধিকারিক জানান —
“আমরা বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, নদীয়া ও মালদা জেলায় দেশজ মাছের প্রজনন কেন্দ্র তৈরি করছি। আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রায় ১০ কোটি দেশজ মাছের পোনা ছাড়া হবে।”
🌾🐠 ধান ও মাছের সহঅস্তিত্ব: পুরনো কৃষি সংস্কৃতির পুনরাবিষ্কার
বাংলার কৃষি ঐতিহ্যে এক বিশেষ জায়গা ছিল ধান-মাছ যৌথ চাষে।
একই জমিতে ধান চাষের সঙ্গে পুকুর-খালে মাছ পালন — এটি একদিকে ফসলের পুষ্টি বাড়ায়, অন্যদিকে খাদ্য বৈচিত্র্য নিশ্চিত করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ‘ইন্টিগ্রেটেড রাইস-ফিশ ফার্মিং’ এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত টেকসই কৃষি মডেল।
রাজ্য সরকার এই পদ্ধতিকে উৎসাহিত করতে “Eco-Farming Clusters” তৈরি করছে, যেখানে কৃষকরা একত্রে দেশজ ধান ও মাছের চাষ করবেন।
🌍 জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ: অর্থনীতি ও পরিবেশের ভারসাম্য
বৈজ্ঞানিকদের মতে, দেশজ প্রজাতি রক্ষা শুধু ঐতিহ্যের বিষয় নয় — এটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে অভিযোজন ক্ষমতা বাড়ায় এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনে।
কারণ দেশজ ধান ও মাছ রাসায়নিক বা অতিরিক্ত ইনপুট ছাড়াই টিকে থাকতে পারে।
এক বিশেষজ্ঞ বলেন,
“আমরা শুধু খাদ্য উৎপাদন নয়, জীববৈচিত্র্যের পুনরুজ্জীবন ঘটাচ্ছি। এটি ভবিষ্যতের পরিবেশবান্ধব কৃষির ভিত্তি তৈরি করবে।”
বাংলার কৃষি ও সংস্কৃতির হৃদয়ে রয়েছে ধান ও মাছ — একে অপরের পরিপূরক।
এই নতুন “Biodiversity Revival Mission – Bengal 2025” উদ্যোগ যদি সফল হয়, তবে রাজ্য কেবল খাদ্য উৎপাদনে নয়, টেকসই কৃষির মডেল হিসেবেও সারা দেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।
দেশজ ধান ও মাছের এই পুনর্জন্ম তাই শুধু কৃষির গল্প নয়, এটি বাংলার মাটির আত্মার পুনরাবিষ্কার।


