কলকাতা: ভারতের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সঙ্গে মিশে আছে “মাছ-ভাত”। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গকে প্রায়শই বলা হয় মাছ-ভাতের দেশ। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য জরিপ-৫ (NFHS-5, ২০১৯-২১) এর তথ্য জানাচ্ছে এক অপ্রত্যাশিত সত্য। জরিপ অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে মাছ খাওয়ার হার ৯৮.৬০ শতাংশ হলেও দেশব্যাপী শীর্ষ পাঁচ রাজ্যের তালিকায় জায়গা পায়নি বাংলা।
শীর্ষে উত্তর-পূর্বাঞ্চল
তথ্য অনুযায়ী, মাছ খাওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি—
- ত্রিপুরা – ৯৯.৩৫%
- মণিপুর – ৯৯.২৫%
- আসাম – ৯৯.১০%
- আরুণাচল প্রদেশ – ৯৯.০৫%
- নাগাল্যান্ড – ৯৮.৮৫%
অর্থাৎ, খুব সামান্য ব্যবধানেই পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষ পাঁচ থেকে বাদ পড়েছে। এই তথ্য বাঙালির দীর্ঘদিনের মাছ-ভাতের গৌরব নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
কেন পিছিয়ে বাংলা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভৌগোলিক ও সামাজিক কারণ এই অবস্থার জন্য দায়ী। পাহাড়ি এবং নদীবাহিত অঞ্চলে মাংসের তুলনায় মাছই বেশি সহজলভ্য, ফলে মাছের প্রতি নির্ভরতা বেড়েছে। খাদ্যবিদ ড. সুপ্রিয় দত্ত বলছেন—
“পশ্চিমবঙ্গে মাছ সংস্কৃতির অংশ হলেও উত্তর-পূর্বে এটি জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। ফলে এই পার্থক্য জরিপে প্রতিফলিত হয়েছে।”
দৈনিক ভোগের হিসাবে এগিয়ে বাংলা
তবে এখানেই শেষ নয়। ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিক রিসার্চ (NCAER)-এর ২০২২ সালের এক সমীক্ষা বলছে, দৈনিক মাছ খাওয়ার দিক থেকে কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গই শীর্ষে। কেরালায় প্রতি ব্যক্তি বছরে প্রায় ৩৬.৫ কেজি মাছ খাওয়া হয়। আর পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক মাছ ভোগের হার দাঁড়িয়েছে ২১.৯০ শতাংশ। অর্থাৎ, গড় সংখ্যায় হয়তো বাংলা কিছুটা পিছিয়েছে, কিন্তু নিয়মিত মাছ খাওয়ার দিক থেকে এখনও এগিয়ে।
উৎপাদনে শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ
এমনকি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গ দেশের সেরা। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১৮ শতাংশই আসে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। গঙ্গা, পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রের ডেল্টা অঞ্চল মাছ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত অনুকূল হওয়ায় বাংলার গ্রামাঞ্চলে মাছ এক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক
এই তথ্য প্রকাশ্যে আসতেই সামাজিক মাধ্যমে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেকের বক্তব্য—“বাংলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সপ্তাহে একাধিকবার মাছ রান্না হয়, তাহলে তালিকায় প্রথম পাঁচে নেই কেন?” অপর একাংশ মনে করছেন, তথ্য সঠিক, কারণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিকল্প খাবারের সীমাবদ্ধতা মাছের ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে।
সরকারি উদ্যোগ
সরকারি স্তরে মাছের উৎপাদন ও সরবরাহ আরও বাড়ানোর উদ্যোগ চলছে। ‘মৎস্য সম্পদ যোজনা’র মতো প্রকল্প গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে আরও বিস্তারিত জরিপ দরকার, যাতে বাংলার মাছ-ভাতের সংস্কৃতির সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব হয়।
সব মিলিয়ে বলা যায়, মাছ-ভাত বাঙালির গর্ব হলেও সংখ্যার হিসাবে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো সামান্য এগিয়ে। তবে উৎপাদন ও দৈনিক ভোগের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ এখনও শীর্ষস্থানে রয়েছে। এই তথ্য প্রমাণ করে, ভারত জুড়ে মাছ শুধু খাদ্য নয়, সংস্কৃতিরও অবিচ্ছেদ্য অংশ।