Fertilizer Tips Winter: শীতকাল মানেই বাংলার কৃষিক্ষেত্রে ফুলকপি ও বাঁধাকপির মরসুম। রাজ্যের হাজার হাজার কৃষক এই দুই ফসলের সঠিক ফলনের ওপর নির্ভর করেই বছরের বড় অংশের আয় নিশ্চিত করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েক বছরে জলবায়ুর অনিশ্চয়তা, মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া, ভুল সারের ব্যবহার এবং রোগপোকার আক্রমণের কারণে অনেক কৃষকই কাঙ্ক্ষিত ফলন পাচ্ছেন না। তাই ২০২৫ সালের শীতকালীন চাষে সর্বোচ্চ ফলন নিশ্চিত করতে কৃষি দপ্তর ও কৃষিবিদরা জোর দিচ্ছেন সঠিক সার ব্যবস্থাপনা (Balanced Fertilization)–এর ওপর।
ফুলকপি ও বাঁধাকপি উভয়ই “heavy feeder crop”, অর্থাৎ মাটি থেকে প্রচুর পুষ্টি শোষণ করে। তাই জমি প্রস্তুত থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত প্রত্যেক ধাপেই সঠিক সার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিবিদদের মতে, সারের সময়, পরিমাণ এবং সারের ধরন, এই তিনটি বিষয় ঠিকঠাক মানলে ফলন কমপক্ষে ২৫–৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
প্রথমেই যা করতে হবে তা হলো মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা। প্রতি তিন বিঘা জমির জন্য অন্তত দু’টি জায়গা থেকে মাটির নমুনা পরীক্ষা করা উচিত। pH মাত্রা যদি ৫.৫–৬.৫ থাকে, তবে ফুলকপি ও বাঁধাকপির বৃদ্ধির জন্য তা আদর্শ। pH কম হলে চুন বা ডোলোমাইট মিশিয়ে মাটির অম্লতা দূর করতে হবে। কারণ অতি-অম্ল মাটিতে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস ঠিকভাবে গাছ শোষণ করতে পারে না।
এরপর জমি প্রস্তুতের সময় প্রথম ধাপ হলো জৈবসার প্রয়োগ। পচা গোবর, জৈব কম্পোস্ট বা ভার্মিকম্পোস্ট অন্তত প্রতি বিঘায় ১২–১৫ কোয়িন্টাল হারে মেশানো উচিত। এতে মাটির গঠন ঝুরঝুরে হয় এবং গাছের মূল বিস্তার ভালোভাবে হয়। জৈবসারের ব্যবহার মাটির মাইক্রোবায়াল কার্যকলাপ বাড়ায়, যা পরবর্তীতে রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়।
ফুলকপি ও বাঁধাকপির সর্বোচ্চ ফলনের জন্য রাসায়নিক সারের মধ্যে নাইট্রোজেন (N), ফসফরাস (P) এবং পটাশ (K) এই তিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিবিদদের মতে, রোপণের সময় বেসাল ডোজ হিসেবে প্রতি বিঘায় ২০–২৫ কেজি DAP, ২০–২৫ কেজি MOP এবং ১০–১৫ কেজি জিপসাম দিলে গাছ শক্ত হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
নাইট্রোজেন সারের ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ম হল ধাপে ধাপে প্রয়োগ, কখনওই একবারে নয়। রোপণের ১৮–২০ দিন পরে প্রথম টপ ড্রেসিং হিসেবে ইউরিয়া দিতে হয়। এরপর ১২–১৫ দিন পর দ্বিতীয়বার ইউরিয়া প্রয়োগ করা উচিত। তবে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন ফুল গঠনে সমস্যা তৈরি করতে পারে, ফলে গাছ অতিরিক্ত সবুজ হবে কিন্তু ফুল ছোট থাকবে। ফুলকপির ক্ষেত্রে “buttoning problem”–এর অন্যতম কারণই হলো অনিয়ন্ত্রিত নাইট্রোজেন ব্যবহার।
ফুলকপি ও বাঁধাকপির জন্য পটাশ সারের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি—যা অনেক কৃষকই খেয়াল করেন না। পটাশ মূলত গাছের শক্তি বৃদ্ধি করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ফুল/কাণ্ডের গুণমান উন্নত করে। পটাশের ঘাটতি হলে বাঁধাকপির মাথা শক্ত হয় না এবং ফুলকপি দানাদার হয়ে যায়। তাই রোপণের ১০–১২ দিনের মধ্যেই প্রতি বিঘায় ১০–১২ কেজি MOP দিতে হবে এবং পরবর্তী পর্যায়ে আরও ৫–৭ কেজি দিতে হবে।
এর পাশাপাশি ম্যাগনেসিয়াম, বোরন এবং ক্যালসিয়াম—এই তিনটি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ফুলকপি ও বাঁধাকপির চাষে অপরিহার্য। বোরনের ঘাটতি হলে ফুলকপি “brown rot” রোগে আক্রান্ত হয় এবং মাথা ভেঙে যায়। তাই রোপণের পর প্রতি বিঘায় ১–১.৫ কেজি বোরাক্স মাটিতে মেশানো উচিত। ক্যালসিয়াম অভাবে বাঁধাকপির পাতায় কালো দাগ দেখা দেয় এবং ফুলকপির ডাঁটা দুর্বল হয়।
এই বছর কৃষি দপ্তর কৃষকদের ফোলিয়ার স্প্রে–র ওপরও জোর দিচ্ছে। বিশেষ করে ১৫ দিন অন্তর ১% ইউরিয়া স্প্রে, ০.৫% বোরন স্প্রে এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট মিশ্রণ স্প্রে করলে গাছের বৃদ্ধি অত্যন্ত ভালো হয়। অনেক কৃষক এখন সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্থাপনা (IPN) অনুসরণ করছেন, যেখানে জৈব ও রাসায়নিক সার একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়।
সারের পাশাপাশি সঠিক সেচ ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত জরুরি। ফুলকপি ও বাঁধাকপির গোড়ায় জল জমে গেলে ফুল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই জমিতে নিকাশি ব্যবস্থা ঠিক রাখা জরুরি। রোপণের পর প্রথম ১৫ দিন সেচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এরপর আবহাওয়া দেখে সেচ দিতে হবে।
রোগপোকার দমনেও সার ব্যবস্থাপনার ভূমিকা আছে। অতিরিক্ত নাইট্রোজেন দিলে এফিড ও মিলিবাগ বেশি আক্রমণ করে। তাই কৃষি দপ্তর কৃষকদের সতর্ক করছে—“যথাযথ নিয়মে সার দিন, চোখ বন্ধ করে নয়।” IPM-এর অধীনে নিম-খোল, ট্র্যাপ ও জৈব কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে।
সব মিলিয়ে, ২০২৫ সালের শীতকালীন চাষে ফুলকপি ও বাঁধাকপির ফলন বাড়াতে সঠিক সারের ব্যবহারই হবে সাফল্যের চাবিকাঠি। সময়মতো সার, সঠিক পরিমাণে সার এবং ফসল অনুযায়ী উপযুক্ত পুষ্টি—এই তিনটি নিয়ম মেনে চললে কৃষকের আয় বাড়বে এবং বাজারেও ভালো মানের সবজি পৌঁছবে।
