বর্ষার শেষ প্রহরে শীতের শুরুতে গোটা দেশের কৃষকরা এখন খরিফ ফসল কাটার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। মাসের পর মাস কঠোর পরিশ্রমের ফল আজ তাঁদের ঘরে তোলার সময়। ধান, ভুট্টা, ডাল, বাজরা কিংবা তুলো—এই মরসুমি ফসলগুলো দেশের খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার পূর্ণ করে। কিন্তু চাষাবাদের শেষ ধাপ, অর্থাৎ ফসল কাটা ও সংরক্ষণ, ঠিকমতো না হলে কৃষকের পরিশ্রম ব্যর্থ হতে পারে। ফলন যেমন কমে যায়, তেমনি বাজারে দরের দিক থেকেও ক্ষতি হয়।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললেই ফসলের উৎপাদন বাড়ানো যায় এবং অপচয় রোধ করা সম্ভব। আজ চলুন দেখে নেওয়া যাক, খরিফ ফসল কাটার সময় কৃষকরা কী কী টিপস মেনে চলবেন।
১. সঠিক সময়ে ফসল কাটা
অতিদ্রুত বা দেরিতে ফসল কাটলে ফলন ও গুণমান দুইই নষ্ট হয়।
ধান: যখন ৮০–৮৫% শিষ সোনালি রঙ ধারণ করে।
ভুট্টা: খোসা শুকিয়ে গেলে এবং দানা শক্ত হলে।
ডাল: শুঁটি শুকনো ও ভঙ্গুর হলে।
তুলো: ফুল সম্পূর্ণ ফেটে শুকনো হলে।
ফসল কাটার আগে একটি ছোট অংশ কেটে পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো।
২. সঠিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার
তীক্ষ্ণ ও ভালো অবস্থার কাস্তে বা যন্ত্র ব্যবহার করলে ফসল কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বড় জমিতে ধান বা ভুট্টার জন্য কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করলে সময় ও শ্রম বাঁচে। ভোঁতা যন্ত্র দিয়ে কাটলে শিষ ভেঙে যাওয়া বা দানা ছিটকে পড়ার ঝুঁকি বেশি।
৩. ভেজা মাটিতে ফসল না রাখা
ফসল কেটে সরাসরি ভিজে মাটিতে রাখলে দ্রুত ছত্রাক বা পচন ধরে। তাই কাটা ফসল পরিষ্কার ত্রিপল, মাদুর বা উঁচু প্ল্যাটফর্মে রাখা উচিত। বৃষ্টি হলে বাতাস চলাচল করে এমন কাপড় (যেমন পাট বা খড়) দিয়ে ঢেকে দেওয়া নিরাপদ।
৪. সঠিকভাবে শুকানো
অতিরিক্ত আর্দ্রতা নষ্টের মূল কারণ। কাটা ফসল অবশ্যই ভালোভাবে শুকিয়ে নেওয়া জরুরি।
সূর্যের তাপে পাতলা স্তরে ছড়িয়ে শুকাতে হবে।
সমানভাবে শুকনোর জন্য বারবার উল্টে দিতে হবে।
মাটিতে সরাসরি না শুকিয়ে পরিষ্কার প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে হবে।
ধান বা শস্যে ১২–১৪% আর্দ্রতা থাকলে সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত হয়।
৫. পরিষ্কার ও বায়ু চলাচল হয় এমন স্থানে সংরক্ষণ
শুকনো শস্য রাখার জন্য পরিষ্কার, শুকনো ও হাওয়া চলাচল করে এমন জায়গা বেছে নিন। শস্যের বস্তাগুলো কাঠের প্যালেট বা উঁচু প্ল্যাটফর্মে রাখুন। গুনির বস্তা বা পাটের বস্তা ব্যবহার করলে বাতাস চলাচল সহজ হয়।
সংরক্ষণস্থল নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে এবং ইঁদুর বা পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচাতে প্রয়োজনে প্রাকৃতিক রিপেলেন্ট বা ফিউমিগেশন ব্যবহার করতে হবে।
৬. সঠিকভাবে পরিবহণ
কাটা ও শুকনো ফসল দ্রুত বাজার বা গোডাউনে পাঠানো জরুরি। পরিষ্কার ও ঢাকা দেওয়া গাড়ি ব্যবহার করলে ধুলো, বৃষ্টি বা রোদ থেকে রক্ষা করা যায়। গাড়ি অতিরিক্ত বোঝাই করা উচিত নয়, এতে শস্য চূর্ণ হয়ে যেতে পারে।
৭. বাজারে পাঠানোর আগে পরিষ্কার ও বাছাই
শস্যের মধ্যে থাকা ভাঙা দানা, খড় বা অন্য আবর্জনা সরিয়ে ফেললে বাজারে দাম বাড়ে। রঙ বা আকার অনুযায়ী বাছাই করলে ফসলের মান আরও উন্নত হয়। পরিষ্কার বস্তায় প্যাকেজিং করলে পরিবহণও নিরাপদ হয় এবং ক্রেতাদের মধ্যে বিশ্বাস বাড়ে।
৮. আবহাওয়ার দিকে নজর
বর্ষা শেষে আবহাওয়া প্রায়ই অনিশ্চিত থাকে। হঠাৎ বৃষ্টি বা অকাল শীতের দাপটে ফসল নষ্ট হতে পারে। তাই আবহাওয়ার খবর নিয়মিত দেখে পরিকল্পনা করুন। বৃষ্টি আসার আশঙ্কা থাকলে ছোট ছোট ভাগে ফসল কাটা বুদ্ধিমানের কাজ।
খরিফ ফসল কাটার সময় একটু সতর্কতা ও সঠিক পরিকল্পনা কৃষকের কষ্টের সঠিক মূল্য এনে দিতে পারে। সঠিক সময়ে কাটা, যথাযথ শুকানো, পরিষ্কারভাবে সংরক্ষণ ও নিরাপদ পরিবহণ—এই চারটি ধাপ মেনে চললে কৃষকরা সর্বোচ্চ ফলন তুলতে পারবেন, আবার অপচয়ও হবে অনেক কম।
আজকের কৃষির মূল বার্তা স্পষ্ট—ফসলের শেষ ধাপেই আসল সাফল্যের পরীক্ষা। যত যত্ন নেওয়া হবে, ততই বাজারে ভালো দাম মিলবে এবং দেশের খাদ্যনিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।


