নয়াদিল্লি, ১ নভেম্বর: ভারতের কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত বিপ্লবের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে — এখন কৃষকরা সেচের জন্য ব্যবহার করছেন ড্রোন প্রযুক্তি (Smart Irrigation Drones)। একসময় যেখানে ড্রোনকে কেবলমাত্র নজরদারি বা সার প্রয়োগের কাজে সীমাবদ্ধ মনে করা হতো, সেখানে এখন তা পরিণত হচ্ছে ‘স্মার্ট ফার্মিং টুল’-এ। সরকারের সহায়তা, বেসরকারি স্টার্টআপ এবং তরুণ কৃষকদের উদ্ভাবনী চিন্তাধারা এই পরিবর্তনকে দ্রুত বাস্তব রূপ দিচ্ছে।
🚜 স্মার্ট সেচের প্রয়োজনীয়তা
জলবায়ু পরিবর্তন, অস্বাভাবিক বৃষ্টি এবং ভূগর্ভস্থ জলের স্তর কমে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেচের চ্যালেঞ্জ ক্রমেই বাড়ছে। কৃষি মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রায় ৫৫% কৃষিজমি এখনো বৃষ্টিনির্ভর। ফলে জল ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা আগের তুলনায় অনেক বেশি।
এই সমস্যার সমাধান হিসেবে উঠে এসেছে ড্রোন-ভিত্তিক স্মার্ট ইরিগেশন সিস্টেম— যেখানে সেন্সর এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)-এর সাহায্যে নির্দিষ্ট এলাকায় প্রয়োজন অনুযায়ী জল ছিটিয়ে দেওয়া হয়।
কৃষি বিজ্ঞানী ড. অমিতাভ চৌধুরী বলেন,
“ড্রোন ব্যবহার করলে জল অপচয় ৩০-৪০% পর্যন্ত কমানো সম্ভব। এটি শুধু সেচ নয়, মাটির আর্দ্রতা ও গাছের স্বাস্থ্য নিরীক্ষার ক্ষেত্রেও দারুণ কার্যকর।”
🌾 কীভাবে কাজ করে ড্রোন ইরিগেশন
এই প্রযুক্তিতে উচ্চ-রেজোলিউশনের ক্যামেরা ও আর্দ্রতা সেন্সর লাগানো ড্রোন ফসলের মাঠের ওপর দিয়ে উড়ে মাটির জলের ঘাটতি ও তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে। তারপর AI অ্যালগরিদম নির্ধারণ করে কোন এলাকায় কতটা জল প্রয়োজন। এরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই পরিমাণ জল ছিটিয়ে দেয় ড্রোন বা সংযুক্ত মাইক্রো-সেচ ব্যবস্থা।
এই পুরো প্রক্রিয়াটি মোবাইল অ্যাপ বা ক্লাউড প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কৃষকরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, ফলে শ্রম ও সময় দুই-ই বাঁচে।
💧 কৃষকদের অভিজ্ঞতা
পাঞ্জাবের লুধিয়ানার কৃষক মনপ্রীত সিং জানান,
“আগে মাঠে সেচ দিতে চারজন শ্রমিক লাগত। এখন একটিমাত্র ড্রোনেই কাজ হয়ে যায়। আমরা দিনে ২৫ একর পর্যন্ত জমিতে জল ছিটাতে পারি, আর জল ব্যবহারও অর্ধেকে নেমে এসেছে।”
অন্যদিকে, মহারাষ্ট্রের নাগপুর জেলার এক তরুণ কৃষক রোহিত পাটিল বলেন,
“ড্রোন শুধু জল ছিটায় না, এটি তাপমাত্রা ও মাটির আর্দ্রতা বিশ্লেষণ করে আমাকে অ্যাপে রিপোর্ট দেয়। কখন ফসলের জল প্রয়োজন, তা আগে থেকেই জানতে পারি।”
🌱 সরকারের উদ্যোগ
কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রক ইতিমধ্যেই ‘কৃষক ড্রোন স্কিম ২০২৫’ চালু করেছে, যার আওতায় কৃষকদের ড্রোন কেনা বা ভাড়ায় নেওয়ার ক্ষেত্রে ৫০% পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। রাজ্য সরকারগুলিকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ড্রোন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে এবং স্থানীয় পর্যায়ে প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে।
এছাড়াও, ড্রোন ম্যানুফ্যাকচারার ও স্টার্টআপ সংস্থাগুলি — যেমন Garuda Aerospace, IoTechWorld Avigation, এবং Skylark Drones — দেশের গ্রামীণ কৃষকদের জন্য সহজ কিস্তিতে ড্রোন সরবরাহ করছে।
🔍 বিশেষজ্ঞদের মত
বিশেষজ্ঞদের মতে, ড্রোন-ভিত্তিক সেচ পদ্ধতি শুধু জল ব্যবস্থাপনায় নয়, ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি এবং খরচ হ্রাসেও সহায়ক হবে।
কৃষি প্রযুক্তিবিদ ড. সীমা নায়ার বলেন,
“AI ও ড্রোনের যুগলবন্দি ভবিষ্যতের কৃষিকে বদলে দেবে। এতে উৎপাদন বাড়বে, কৃষকরা আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হবেন, এবং জল সংরক্ষণে ভারত একটি মডেল দেশ হিসেবে উঠবে।”
⚙️ ভবিষ্যতের কৃষি
২০২৫ সালের মধ্যে ভারত সরকার চায় কমপক্ষে ১ লক্ষ ড্রোন কৃষিক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার হোক। জল সংকট ও শ্রম ঘাটতির মতো সমস্যার সমাধানে এই প্রযুক্তি গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
যেভাবে মোবাইল ফোন একসময় গ্রামীণ যোগাযোগের চেহারা বদলে দিয়েছিল, তেমনভাবেই ড্রোন বদলে দিচ্ছে ভারতের কৃষি ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ।


