গত এক দশকে ভারতে গ্রুপ ইন্স্যুরেন্সের (Group Health Insurance) ভূমিকা কেবলমাত্র কর্মচারীদের বেনিফিট দেওয়ার সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে গিয়ে আজ একটি কৌশলগত মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার অংশে পরিণত হয়েছে। এখনকার দিনে কোম্পানিগুলো প্রতিভা ধরে রাখার এবং আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিমাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে দেখছে।
স্বাস্থ্যই সম্পদ, কিন্তু ব্যয় বাড়ছে লাগামছাড়া
ভারতে চিকিৎসা ব্যয় আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। ২০২৩ সালে মেডিকেল ইনফ্লেশন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪% হারে, যা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসা খরচ প্রতি ছয় বছরে দ্বিগুণ হচ্ছে। করোনা পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে ভর্তি, উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি ও ডায়াগনোস্টিক খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
এছাড়া, লাইফস্টাইল জনিত অসুস্থতা যেমন ডায়াবেটিস (১১.৪%), উচ্চ রক্তচাপ (৩৫.৫%) ও স্থূলতা (২৮.৬%) – এইসব নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ (NCDs)-এর প্রকোপও বাড়ছে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাও উদ্বেগজনক। ২০২২ সালের এক গবেষণায় ডেলয়েট জানায়, মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কারণে বছরে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে ভারতীয় ব্যবসায়।
প্রিমিয়ামের চাপ ও টেকসই মডেলের অভাব
ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলি যদিও প্রতিযোগিতামূলক প্রিমিয়াম রেট বজায় রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু ক্রমবর্ধমান ক্লেইম কস্ট ও চিকিৎসা ব্যয়ের চাপে এই মডেল আজ ভেঙে পড়ার মুখে। দীর্ঘদিন ধরে প্রিমিয়াম কম রাখার চেষ্টা এখন বুমেরাং হতে চলেছে। যদি এই ট্রেন্ড চলতে থাকে, তাহলে কোম্পানিগুলো হঠাৎ করেই প্রিমিয়ামে বড়সড় বাড়তি চাপ ফেলতে বাধ্য হবে—যা কর্মচারী ও কোম্পানি উভয়ের বাজেট পরিকল্পনাকে বিপর্যস্ত করতে পারে।
সংস্থার আকার ও কর্মীবাহিনীর প্রভাব
একটি সংস্থার কর্মচারীর সংখ্যা ও তাদের স্বাস্থ্যগত প্রোফাইল গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়ামে বড় প্রভাব ফেলে। বৃহৎ সংস্থাগুলি তুলনামূলকভাবে ভালো দর কষাকষি করতে পারে। আবার তরুণ ও সুস্থ কর্মীবাহিনীর জন্য প্রিমিয়াম কম পড়ে। কিন্তু বয়স্ক কর্মী বা হাই-রিস্ক পুল থাকলে ব্যয় বেড়ে যায়।
ভৌগোলিক ও হাসপাতাল নেটওয়ার্কের দিক থেকে বৈচিত্র
দেশের বিভিন্ন রাজ্যে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় ভিন্ন। কিছু রাজ্যে খরচ অনেক বেশি, আবার কিছু রাজ্যে তুলনামূলক কম। এর প্রভাব ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়ামেও পড়ে। যারা বিস্তৃত হাসপাতাল নেটওয়ার্ক সহ পলিসি চায়, তাদের প্রিমিয়াম সাধারণত বেশি, তবে কর্মীদের সন্তুষ্টিও বেশি থাকে।
সমাধানের পথ: স্বাস্থ্য সচেতনতা ও প্রযুক্তির ব্যবহার
কোম্পানিগুলো চাইলেই খরচ কমানোর পাশাপাশি গুণগত কভারেজ বজায় রাখতে পারে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ফিটনেস প্রোগ্রাম, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কর্মসূচি ইত্যাদির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা খরচ অনেকটাই কমানো সম্ভব। কর্মীদের জন্য কাস্টমাইজড বেনিফিট প্যাকেজ চালু করা যেতে পারে যাতে তারা নিজের প্রয়োজনে বেছে নিতে পারেন। হেলথ রিম্বার্সমেন্ট অ্যারেঞ্জমেন্ট (HRA) ও মেডিকেল স্টাইপেন্ড ব্যবস্থাও কার্যকর হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় সংস্থাগুলির উচিত হেলথ অ্যাকচুয়ারির মাধ্যমে তাদের ইন্স্যুরেন্স পোর্টফোলিওর পুনর্মূল্যায়ন করা। এতে টেকসই প্রিমিয়াম কাঠামো গড়ে তোলা সহজ হবে।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ: একসঙ্গে পথ খোঁজা
এই মুহূর্তে প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা। সংস্থাগুলি, ইন্স্যুরার ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সম্মিলিত উদ্যোগে গড়ে উঠতে হবে এমন মডেল, যা খরচ ও কভারেজের ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম।
- রিস্ক-ভিত্তিক প্রাইসিং: কর্মীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে প্রিমিয়াম নির্ধারণ।
- ওয়েলনেস লিংকড ইন্স্যুরেন্স: স্বাস্থ্য সচেতন কর্মীদের জন্য কম প্রিমিয়াম ও বেশি বেনিফিট।
- ডেটা-ড্রিভেন আন্ডাররাইটিং: প্রযুক্তির সহায়তায় সঠিক রিস্ক মূল্যায়ন ও ন্যায্য প্রিমিয়াম কাঠামো গঠন।
- কস্ট শেয়ারিং মডেল: কর্মী ও নিয়োগকর্তা উভয়ের মধ্যে খরচ ভাগাভাগি করে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা।
- এই উদ্যোগগুলিতে ইন্স্যুরেন্স ব্রোকাররাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। তাদের মাধ্যমে বেনিফিট বেন্চমার্কিং, প্রিমিয়াম প্রজেকশন ও ডিজিটাল এনাবলমেন্টের সুযোগ তৈরি হয়।
চিকিৎসা ব্যয় ও জনসংখ্যার ঝুঁকি-প্রোফাইলের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে গ্রুপ ইন্স্যুরেন্সের টেকসই রূপ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। আমাদের সকলের—চাকরিদাতা, ইন্স্যুরার, নীতিনির্ধারক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের একযোগে কাজ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের জন্য একটি কার্যকর, টেকসই ও কর্মীবান্ধব ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়।