দিল্লি পুলিশ ঘোষণা করেছে যে, এখন থেকে যারা বিদেশি নাগরিক হিসেবে সন্দেহভাজন এবং রাজধানীতে অবৈধভাবে বসবাস করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য শুধুমাত্র ভোটার আইডি কার্ড বা পাসপোর্ট গ্রহণ করা হবে।
আধার কার্ড (Aadhaar) , প্যান কার্ড এবং রেশন কার্ডের মতো নথিগুলি এই ধরনের ক্ষেত্রে আর বৈধ প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হবে না। এই সিদ্ধান্তের পিছনে রয়েছে গত বছরের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যাচাই-বাছাই অভিযানে প্রাপ্ত তথ্য, যেখানে দেখা গেছে যে অনেক অবৈধ বিদেশি নাগরিক, বিশেষ করে বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গারা, আধার, রেশন বা প্যান কার্ড ব্যবহার করে নিজেদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে মিথ্যা দাবি করছে।
একজন ঊর্ধ্বতন দিল্লি পুলিশ অফিসার, যিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন, জানিয়েছেন, “আমাদের যাচাই অভিযানের সময় দেখা গেছে যে অবৈধ অভিবাসীরা আধার, রেশন এবং প্যান কার্ড সংগ্রহ করেছে এবং এগুলি ব্যবহার করে ভারতীয় নাগরিকত্বের মিথ্যা দাবি করছে।
কিছু ক্ষেত্রে তারা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) থেকে জারি করা কার্ডও দেখিয়েছে। ফলে, ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ভোটার আইডি বা পাসপোর্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, দিল্লির সমস্ত জেলার ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশকে (ডিসিপি) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন তারা তাদের এলাকায় “সন্দেহজনক ব্যক্তিদের” কার্যকলাপের উপর কড়া নজর রাখেন।
অফিসারটি জানান, “অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে যতক্ষণ না শেষ ব্যক্তিটিকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়। ভারতে বৈধ ভ্রমণ নথি ছাড়া ইউএনএইচসিআর-এর শরণার্থী মর্যাদার কোনও গুরুত্ব নেই। ফলে, এই ধরনের বিদেশি নাগরিকদের নির্বাসনের জন্য প্রয়োজনে আমরা গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সঙ্গে সমন্বয় করব।”
পাকিস্তানি নাগরিকদের উপর কড়া নজরদারি:
একটি সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্দেশ আরও জোরদার হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের পাহাড়গামে পর্যটকদের উপর সন্ত্রাসী হামলায় ২৮ জন নিহত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছে। দিল্লিতে বসবাসরত প্রায় ৩,৫০০ পাকিস্তানি নাগরিকের মধ্যে প্রায় ৫২০ জন মুসলিম। এদের মধ্যে ৪০০ জনেরও বেশি ইতিমধ্যে শনিবার পর্যন্ত আটারি সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানে ফিরে গেছেন। এই ব্যক্তিরা বেশিরভাগই স্বল্পমেয়াদী ভিসায় ভারতে এসেছিলেন।
দ্বিতীয় একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার জানিয়েছেন, “ফরেন রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস (এফআরআরও) আমাদের সঙ্গে একটি তালিকা শেয়ার করেছে। এই তালিকায় দীর্ঘমেয়াদী ভিসা (এলটিভি) ধারী হিন্দু পাকিস্তানি নাগরিকদের নামও রয়েছে, যারা এই নির্দেশ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। সমস্ত জেলাকে এই তালিকার ভিত্তিতে আরও যাচাই ও শনাক্তকরণের কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, এই বিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং দিল্লি পুলিশকে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। “দিল্লি পুলিশের কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দা ব্যুরোকে (আইবি) দিল্লিতে বসবাসরত পাকিস্তানি নাগরিকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে এবং তাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারত ছাড়তে বলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”
কেন্দ্রীয় নির্দেশ ও ভিসা বাতিল:
গত শুক্রবার, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক (এমএইচএ) একটি আদেশ জারি করে জানিয়েছে যে, চিকিৎসা, কূটনৈতিক এবং দীর্ঘমেয়াদী ভিসা ছাড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের সমস্ত ভিসা ২৭ এপ্রিল থেকে বাতিল করা হবে। বিদ্যমান চিকিৎসা ভিসাগুলিও ২৯ এপ্রিলের পর অবৈধ হয়ে যাবে। তবে, সরকার পরে স্পষ্ট করেছে যে, হিন্দু পাকিস্তানি নাগরিকদের ইতিমধ্যে প্রদত্ত দীর্ঘমেয়াদী ভিসাগুলি বৈধ থাকবে।
অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ:
দিল্লি পুলিশের এই পদক্ষেপ অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতির অংশ। বিশেষ করে বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা অভিবাসীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তারা জাল নথি ব্যবহার করে ভারতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করছে। এই নথিগুলি তাদের চাকরি, সরকারি সুবিধা এবং এমনকি ভোটাধিকারের মতো সুযোগ-সুবিধা পেতে সহায়তা করছে। পুলিশের মতে, এই ধরনের অবৈধ কার্যকলাপ শনাক্ত করতে এবং নির্বাসন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে ভোটার আইডি এবং পাসপোর্টের মতো নির্ভরযোগ্য নথির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
পাহাড়গাম হামলার প্রভাব:
পাহাড়গামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উপর নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এই হামলার পর কেন্দ্রীয় সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ভিসা বাতিল এবং আটারি সীমান্ত বন্ধ করা। দিল্লিতে বসবাসরত পাকিস্তানি নাগরিকদের তালিকা তৈরি এবং তাদের নির্বাসনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:
দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, এই অভিযান কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়, বরং দেশের নিরাপত্তা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য। অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্তকরণ এবং নির্বাসন প্রক্রিয়ায় কোনও নিরীহ ব্যক্তিকে হয়রানি করা হবে না বলে তারা আশ্বাস দিয়েছে। তবে, যারা জাল নথি ব্যবহার করে ভারতে থাকছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
দিল্লি পুলিশের এই নতুন নির্দেশিকা অবৈধ অভিবাসনের সমস্যা মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ভোটার আইডি এবং পাসপোর্টের মতো নির্ভরযোগ্য নথির উপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে সরকার ভারতীয় নাগরিকত্বের অপব্যবহার রোধ করতে চায়। পাহাড়গাম হামলার পর পাকিস্তানি নাগরিকদের নির্বাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হওয়ায়, দিল্লি পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলি দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পরিশ্রম করছে। এই পদক্ষেপ ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার করতে এবং অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণের প্রতিফলন।

আমাদের Google News এ ফলো করুন
২৪ ঘণ্টার বাংলা নিউজ, ব্রেকিং আপডেট আর এক্সক্লুসিভ স্টোরি সবার আগে পেতে ফলো করুন।
