২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অষ্টম কেন্দ্রীয় বেতন কমিশন (8th Pay Commission) গঠনের অনুমোদন দিয়েছে, যা ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই কমিশন প্রায় ৫০ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং ৬৫ লক্ষ পেনশনভোগীদের জন্য বেতন, ভাতা এবং পেনশন সংশোধনের সুপারিশ করবে। এই প্রেক্ষিতে, প্রবীণ নাগরিক (Senior Citizens) এবং পারিবারিক পেনশনভোগীরা বিশেষভাবে উৎসাহিত, কারণ তাঁরা এই কমিশনের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য পেনশন বৃদ্ধি এবং আর্থিক সুরক্ষার প্রত্যাশা করছেন। বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যসেবার ক্রমবর্ধমান খরচের কারণে পেনশনভোগীদের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করব, প্রবীণ নাগরিক এবং পারিবারিক পেনশনভোগীরা অষ্টম সিপিসি থেকে কী আশা করছেন এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব কী হতে পারে।
প্রবীণ নাগরিক ও পারিবারিক পেনশনভোগীদের প্রত্যাশা
প্রবীণ নাগরিক এবং পারিবারিক পেনশনভোগীরা, যাঁরা মৃত সরকারি কর্মচারীদের পত্নী বা নির্ভরশীল পরিবারের সদস্য, তাঁরা অষ্টম সিপিসি থেকে নিম্নলিখিত দাবিগুলো উত্থাপন করছেন:
১. পেনশন বৃদ্ধি ও ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর: সপ্তম বেতন কমিশন ২.৫৭ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর প্রয়োগ করে ন্যূনতম পেনশন ৩,৫০০ টাকা থেকে ৯,০০০ টাকায় এবং সর্বোচ্চ পেনশন ৪৫,০০০ টাকা থেকে ১,১৫,৬৫০ টাকায় উন্নীত করেছিল। অষ্টম সিপিসি-তে, পেনশনভোগী সংগঠনগুলো ২.৮৬ থেকে ৩.৬৮ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর দাবি করছে, যা ন্যূনতম পেনশনকে ২৫,৭৪০ টাকা এবং সর্বোচ্চ পেনশনকে ৩,৫৭,৫০০ টাকা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। এই বৃদ্ধি প্রবীণ নাগরিকদের জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ।
২. পারিবারিক পেনশন সংস্কার: পারিবারিক পেনশন, যা মৃত কর্মচারীর পরিবারের সদস্যদের প্রদান করা হয়, বর্তমানে মূল পেনশনের ৩০% থেকে ৫০%। পেনশনভোগী সংগঠনগুলো দাবি করছে যে পারিবারিক পেনশনের হার বাড়িয়ে ৫০% থেকে ৬০% করা হোক এবং এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিপিসি-র সুপারিশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন কর্মচারীর পেনশন ২০,০০০ টাকা হয়, তবে তাঁর মৃত্যুর পর পত্নী বা নির্ভরশীলরা বর্তমানে ৬,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা পান। অষ্টম সিপিসি-তে এই পরিমাণ বাড়িয়ে ১২,০০০ টাকা করার দাবি উঠেছে।
৩. মহার্ঘ ভাতা (DA) সংশোধন: বর্তমানে মহার্ঘ ভাতা (Dearness Relief, DR) মূল পেনশনের ৫৩%। এটি মুদ্রাস্ফীতি এবং ভোক্তা মূল্য সূচকের (CPI) সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতি ছয় মাসে সংশোধিত হয়। পেনশনভোগীরা চান যে অষ্টম সিপিসি-তে DR-এর একটি অংশ মূল পেনশনে যুক্ত করা হোক, যাতে পেনশনের মোট পরিমাণ বাড়ে। উদাহরণস্বরূপ, ১০,০০০ টাকা মূল পেনশনের ক্ষেত্রে বর্তমানে ৫,৩০০ টাকা DR সহ মোট ১৫,৩০০ টাকা পাওয়া যায়।
৪. স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা: প্রবীণ নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ। তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্প (CGHS) এর আওতায় আরও হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন। এছাড়াও, চিকিৎসা ভাতা (Medical Allowance) বাড়িয়ে ৩,০০০ টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে, বিশেষ করে যাঁরা CGHS-এর আওতায় নেই তাঁদের জন্য।
৫. গ্র্যাচুইটি সীমা বৃদ্ধি: বর্তমানে অবসরকালীন গ্র্যাচুইটির সীমা ২০ লক্ষ টাকা, যা অষ্টম সিপিসি-তে ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ টাকায় উন্নীত করার দাবি উঠেছে। এটি প্রবীণ নাগরিক এবং তাঁদের পরিবারের জন্য আর্থিক সুরক্ষা বাড়াবে।
৬. পেনশন প্যারিটি: রেলওয়ে সিনিয়র সিটিজেন ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (RSCWS)-এর মতো সংগঠনগুলো দাবি করছে যে ২০২৬ সালের আগে অবসরপ্রাপ্ত পেনশনভোগীরা যেন নতুন সিপিসি-র সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হন। ফিনান্স বিল ২০২৫-এর কিছু সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, যা থেকে ধারণা করা হয়েছিল যে পুরোনো পেনশনভোগীরা সুবিধা থেকে বাদ পড়তে পারেন। তবে, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন এই দাবি খণ্ডন করে বলেছেন, পেনশন প্যারিটি বজায় থাকবে।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কণ্ঠস্বর
প্রবীণ নাগরিক এবং পারিবারিক পেনশনভোগীদের কণ্ঠস্বর শুনে বোঝা যায়, তাঁদের প্রত্যাশা কেবল আর্থিক বৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দিল্লির একজন অবসরপ্রাপ্ত রেলওয়ে কর্মচারী বলেন, “মুদ্রাস্ফীতির কারণে আমাদের পেনশন দিয়ে জীবনযাত্রা চালানো কঠিন। অষ্টম সিপিসি-তে পেনশন বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা বাড়ানো আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।” কলকাতার একজন পারিবারিক পেনশনভোগী বলেন, “আমার স্বামীর মৃত্যুর পর পেনশন আমার একমাত্র আয়। এটি বাড়ানো হলে আমার জীবনযাত্রা সহজ হবে।”
মুম্বইয়ের একজন প্রবীণ নাগরিক বলেন, “আমরা চাই CGHS-এ আরও বেশি হাসপাতাল অন্তর্ভুক্ত হোক, যাতে আমাদের চিকিৎসার জন্য দূরে যেতে না হয়।” উত্তর-পূর্ব ভারতের একজন পেনশনভোগী বলেন, “দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী পেনশনভোগীদের জন্য বিশেষ ভাতা প্রয়োজন।”
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
অষ্টম সিপিসি-র সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে প্রায় ১.৮ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক বোঝা বহন করতে হবে। এই ব্যয় রাজ্য সরকারগুলোর উপরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যারা কেন্দ্রীয় সুপারিশের ভিত্তিতে তাদের পেনশন কাঠামো সংশোধন করে। তবে, পেনশন বৃদ্ধির ফলে প্রবীণ নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হতে পারে।
রেলওয়ে সিনিয়র সিটিজেন ওয়েলফেয়ার সোসাইটির মতো সংগঠনগুলো সরকারের কাছে দ্রুত কমিশন গঠন এবং স্বচ্ছ টার্মস অফ রেফারেন্স (ToR) প্রকাশের দাবি জানিয়েছে। বর্তমানে কমিশনের চেয়ারপার্সন এবং সদস্য নিয়োগের প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় পেনশনভোগীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
অষ্টম বেতন কমিশন প্রবীণ নাগরিক এবং পারিবারিক পেনশনভোগীদের জন্য একটি নতুন আশার আলো। তাঁদের দাবি—পেনশন বৃদ্ধি, পারিবারিক পেনশন সংস্কার, স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা বৃদ্ধি এবং গ্র্যাচুইটি সীমা বাড়ানো—শুধুমাত্র আর্থিক নিরাপত্তাই নিশ্চিত করবে না, বরং তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে। সরকারের উপর এখন দায়িত্ব রয়েছে এই দাবিগুলো পূরণে স্বচ্ছ এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অষ্টম সিপিসি-র সফল বাস্তবায়ন ভারতের প্রবীণ নাগরিকদের জন্য একটি সম্মানজনক এবং নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে পারে।