অষ্টম বেতন কমিশনের অধীনে শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। ২০২৫ সালের মধ্যে শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হয়ে উঠেছে। শিক্ষক সম্প্রদায়, বিশেষ করে সরকারি ও সরকার-পোষিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, তাঁদের কাজের গুরুত্ব এবং জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের প্রেক্ষিতে ন্যায্য বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা অষ্টম বেতন কমিশনের সর্বশেষ আপডেট, শিক্ষকদের দাবি এবং সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
অষ্টম বেতন কমিশন: পটভূমি
ভারত সরকার প্রতি দশকে একবার কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা সংশোধনের জন্য একটি বেতন কমিশন গঠন করে। সপ্তম বেতন কমিশন ২০১৬ সালে কার্যকর হয়েছিল, যার ফলে কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে, শিক্ষক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ মনে করে যে তাঁদের বেতন কাঠামো এখনও জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মুদ্রাস্ফীতি, শিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং শিক্ষকদের কাজের চাপের কথা বিবেচনা করে, অষ্টম বেতন কমিশনের মাধ্যমে একটি উল্লেখযোগ্য বেতন বৃদ্ধির দাবি উঠেছে।
২০২৪ সালে, কেন্দ্রীয় সরকার অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। যদিও এখনও পর্যন্ত কমিশনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বা তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি, শিক্ষক সংগঠনগুলি তাদের দাবি জোরালোভাবে উপস্থাপন করছে। শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি, ভাতা সংশোধন এবং পেনশন সুবিধার উন্নতি এই দাবির মূল বিষয়।
শিক্ষকদের প্রধান দাবি
শিক্ষক সংগঠনগুলি, যেমন অল ইন্ডিয়া ফেডারেশন অফ টিচার্স অর্গানাইজেশন (AIFTO) এবং অন্যান্য রাজ্য-ভিত্তিক সংগঠন, নিম্নলিখিত দাবিগুলি তুলে ধরেছে:
- বেতন বৃদ্ধি: সপ্তম বেতন কমিশনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৫৭ ছিল, যা শিক্ষকদের মতে পর্যাপ্ত ছিল না। অষ্টম বেতন কমিশনে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ৩.০ বা তার বেশি করার দাবি উঠেছে। এটি শিক্ষকদের মূল বেতন বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
- মহার্ঘ ভাতা (DA): বর্তমানে মহার্ঘ ভাতা ৫০% ছুঁয়েছে, তবে শিক্ষকরা দাবি করছেন যে এটি অষ্টম বেতন কমিশনের অধীনে সংশোধিত বেতন কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত করা হোক।
- পেনশন সুবিধা: পুরনো পেনশন স্কিম (OPS) পুনর্বহালের দাবি শিক্ষকদের মধ্যে জোরালো। নতুন পেনশন স্কিম (NPS) তাঁদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করছে না বলে অভিযোগ।
- কর্ম পরিবেশ: শিক্ষকরা আরও ভালো কর্মপরিবেশ, কম প্রশাসনিক চাপ এবং শিক্ষার মান উন্নতির জন্য পর্যাপ্ত সংস্থানের দাবি করছেন।
- রাজ্য শিক্ষকদের জন্য সমতা: কেন্দ্রীয় শিক্ষকদের পাশাপাশি রাজ্য সরকারি শিক্ষকদের জন্যও সমান বেতন বৃদ্ধির দাবি উঠেছে।
সর্বশেষ আপডেট
২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত অষ্টম বেতন কমিশনের গঠন নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়নি। তবে, কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলি এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ বা ২০২৬ সালের শুরুতে অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর বেতন বৃদ্ধি কার্যকর হতে আরও এক থেকে দুই বছর সময় লাগতে পারে।
শিক্ষক সংগঠনগুলি এই বিষয়ে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। ২০২৪ সালে দিল্লি এবং অন্যান্য রাজ্যে শিক্ষকদের বিক্ষোভ ও সমাবেশ লক্ষ্য করা গেছে। পশ্চিমবঙ্গে, শিক্ষক সংগঠনগুলি রাজ্য সরকারের কাছে অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ গ্রহণের জন্য আলোচনা শুরু করেছে। তবে, রাজ্য সরকার এখনও কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।
শিক্ষকদের প্রত্যাশা
শিক্ষকরা আশা করছেন যে অষ্টম বেতন কমিশন তাঁদের বেতন কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, যাঁদের বেতন তুলনামূলকভাবে কম, তাঁরা ন্যূনতম বেতন ২৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা করার দাবি জানাচ্ছেন। এছাড়াও, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ইউজিসি বেতন স্কেলের সংশোধনের দাবি করছেন।
পশ্চিমবঙ্গে, শিক্ষক সংগঠনগুলি মনে করে যে রাজ্যের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো কেন্দ্রীয় শিক্ষকদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। তাই, তারা অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ রাজ্য স্তরেও কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছেন।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
অষ্টম বেতন কমিশন বাস্তবায়নের পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, সরকারের আর্থিক সক্ষমতা এই বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি বড় প্রশ্ন। মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে সরকার কতটা বেতন বৃদ্ধি করতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে জটিল করতে পারে। তৃতীয়ত, শিক্ষক সংগঠনগুলির মধ্যে ঐক্যের অভাব এবং বিভিন্ন দাবির পার্থক্যও একটি বাধা হতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপট
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি দীর্ঘদিনের। রাজ্যে শিক্ষক সংগঠনগুলি, যেমন অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন, কেন্দ্রীয় বেতন কাঠামোর সমতা এবং মহার্ঘ ভাতার নিয়মিত সংশোধনের দাবি জানাচ্ছে। ২০২৪ সালে রাজ্য সরকার মহার্ঘ ভাতা ৪% বাড়িয়েছে, কিন্তু শিক্ষকরা এটিকে অপর্যাপ্ত বলে মনে করছেন। অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ গ্রহণের জন্য রাজ্য সরকারের উপর চাপ বাড়ছে।
অষ্টম বেতন কমিশন শিক্ষকদের জন্য একটি নতুন আশার আলো হতে পারে, তবে এর বাস্তবায়ন এখনও অনিশ্চিত। শিক্ষক সংগঠনগুলি তাদের দাবি নিয়ে সোচ্চার থাকলেও, সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভর করছে ফলাফল। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষকরা আশা করছেন যে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার তাঁদের দাবি মেনে নেবে এবং শিক্ষার মান উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আগামী কয়েক মাসে এই বিষয়ে আরও স্পষ্টতা আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।