ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের জন্য অষ্টম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) নিয়ে উৎসাহ ও প্রত্যাশা ক্রমশ বাড়ছে। ২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই কমিশনের গঠনের অনুমোদন দেওয়ার পর থেকেই আলোচনা তুঙ্গে। এই কমিশনের সুপারিশ ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রায় ৫০ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং ৬৫ লক্ষেরও বেশি পেনশনভোগী এই কমিশনের সুবিধা পাবেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। পেনশনভোগীদের জন্য এই কমিশন কী কী পরিবর্তন আনতে পারে এবং তাদের অবসরকালীন আয়ে এর প্রভাব কী হবে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
পেনশন বৃদ্ধির সম্ভাবনা
অষ্টম বেতন কমিশনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হল ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর (Fitment Factor)। এটি এমন একটি গুণক যা বেতন এবং পেনশনের পরিমাণ নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়। সপ্তম বেতন কমিশনে এই ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ছিল ২.৫৭, যার ফলে ন্যূনতম বেসিক বেতন ৭,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮,০০০ টাকা এবং ন্যূনতম পেনশন ৩,৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৯,০০০ টাকা হয়েছিল। অষ্টম বেতন কমিশনের জন্য ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.২৮ থেকে ২.৮৬-এর মধ্যে হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হয়, তাহলে ন্যূনতম পেনশন ৯,০০০ টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ২৫,৭৪০ টাকা হতে পারে, যা ১৮৬ শতাংশ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনও পেনশনভোগীর বর্তমান বেসিক পেনশন ৩০,০০০ টাকা হয়, তাহলে ২.৫ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টরে তা বেড়ে ৭৫,০০০ টাকা হতে পারে। এই বৃদ্ধি পেনশনভোগীদের জন্য উল্লেখযোগ্য আর্থিক স্বস্তি আনতে পারে।
ইউনিফায়েড পেনশন স্কিম (UPS)
অষ্টম বেতন কমিশনের সঙ্গে ইউনিফায়েড পেনশন স্কিম (Unified Pension Scheme) নিয়েও আলোচনা চলছে। এই প্রকল্পের আওতায়, ২৫ বছর বা তার বেশি সময় ধরে চাকরি করা কর্মচারীরা তাঁদের শেষ ১২ মাসের গড় বেসিক বেতনের ৫০ শতাংশ পেনশন হিসেবে পাবেন। এছাড়া, ন্যূনতম ১০ বছর চাকরির জন্য পেনশনের পরিমাণ কমপক্ষে ১০,০০০ টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। এই প্রকল্পটি পেনশন গণনাকে আরও সরল করবে এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের জন্য আরও স্থিতিশীল আর্থিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে।
পেনশনভোগীদের মধ্যে বৈষম্য নিয়ে বিতর্ক
অষ্টম বেতন কমিশন নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য বিতর্ক হল, ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারির আগে অবসর নেওয়া পেনশনভোগীরা এই কমিশনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন কিনা। ফিনান্স বিল ২০২৫-এ সেন্ট্রাল সিভিল সার্ভিসেস (CCS) পেনশন নিয়মে কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে, যা নিয়ে বিরোধী দলগুলি, বিশেষ করে কংগ্রেস, সরকারের বিরুদ্ধে ‘গোপন উদ্দেশ্য’ থাকার অভিযোগ তুলেছে। তবে, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, এই সংশোধনীগুলি কেবল প্রক্রিয়াগত এবং পেনশন সুবিধার কোনও পরিবর্তন ঘটাবে না। তিনি আরও বলেছেন, সপ্তম বেতন কমিশনের মতোই, ২০২৬-এর আগে এবং পরে অবসরপ্রাপ্ত পেনশনভোগীদের মধ্যে কোনও বৈষম্য থাকবে না।
পেনশন গণনার পদ্ধতি
অষ্টম বেতন কমিশন পেনশন গণনার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে। সপ্তম বেতন কমিশনে পেনশন নির্ধারণের জন্য দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল:
১. নোটিশনাল পে মেথড: অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীর বেতন ব্যান্ড এবং গ্রেড পে অনুযায়ী পে ম্যাট্রিক্সে তাঁর বেতন নির্ধারণ করা হয়। এরপর, চাকরিকালে অর্জিত ইনক্রিমেন্টের ৩ শতাংশ হারে বেতন বাড়ানো হয়। এই পরিমাণের ৫০ শতাংশই পেনশন হিসেবে দেওয়া হয়।
২. ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর মেথড: বর্তমান বেসিক পেনশনকে ২.৫৭ গুণ করা হয়। এই দুটি পদ্ধতির মধ্যে যেটি বেশি, সেটিই চূড়ান্ত পেনশন হিসেবে গৃহীত হয়।
অষ্টম বেতন কমিশনও এই ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে, তবে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর বাড়ানোর ফলে পেনশনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের প্রত্যাশা
পেনশনভোগীদের প্রতিনিধি সংগঠনগুলি, যেমন রেলওয়ে সিনিয়র সিটিজেন ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (RSCWS), অষ্টম বেতন কমিশনের কাছে বেশ কিছু দাবি তুলেছে। তাঁরা মনে করেন, পেনশন গণনার জন্য ব্যবহৃত ‘আইক্রয়েডের ২৭০০ ক্যালরি মডেল’ এখন আর প্রাসঙ্গিক নয় এবং এটি বাতিল করা উচিত। এছাড়া, তাঁরা দাবি করেছেন যে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ডেটা-ভিত্তিক হওয়া উচিত, ধারণার ওপর নির্ভরশীল নয়। সপ্তম বেতন কমিশনের সময় পেনশন পুনর্নির্ধারণের জন্য পেনশনভোগীদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, যা প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলেছিল। এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশগুলি আরও সুগঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
অষ্টম বেতন কমিশনের বাস্তবায়ন সরকারের ওপর প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক বোঝা চাপাতে পারে। তবে, এই বৃদ্ধি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পেনশনভোগীদের হাতে অতিরিক্ত আয় এলে তাঁদের ব্যয় বাড়বে, যা পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বাড়িয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। এছাড়া, বেতন ও পেনশন বৃদ্ধির ফলে সরকারের কর আয়ও বাড়বে।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
যদিও অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশগুলি পেনশনভোগীদের জন্য সুখবর বয়ে আনতে পারে, তবে বাস্তবায়নের সময়সীমা নিয়ে কিছু অনিশ্চয়তা রয়েছে। কিছু রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালের জানুয়ারির পরিবর্তে এই সুপারিশগুলি ২০২৬-২৭ অর্থবছরে কার্যকর হতে পারে। এই ক্ষেত্রে, পেনশনভোগীদের বকেয়া পেনশন দেওয়া হতে পারে।
অষ্টম বেতন কমিশন পেনশনভোগীদের জন্য একটি নতুন আশার আলো নিয়ে আসছে। ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর বৃদ্ধি এবং ইউনিফায়েড পেনশন স্কিমের মতো প্রকল্পগুলি তাঁদের আর্থিক সুরক্ষা ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারে। তবে, সরকারের চূড়ান্ত সুপারিশ এবং বাস্তবায়নের সময়সীমার ওপর নির্ভর করবে এই পরিবর্তনের প্রকৃত প্রভাব। পেনশনভোগীদের উচিত সরকারি ঘোষণার ওপর নজর রাখা এবং অষ্টম বেতন কমিশনের সুবিধাগুলি সম্পর্কে সঠিক তথ্যের জন্য অফিসিয়াল সূত্রের ওপর নির্ভর করা।