ভারতে বীমা (Life Insurance) খাতে এক চমকপ্রদ ও উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায়। ইনসুরেন্স অ্যাডভাইজরি অ্যাপ CoverSure-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের ৭৯ শতাংশ বীমা পলিসিধারী নিশ্চিত নন যে তাঁদের বীমা নীতিতে পর্যাপ্ত কভারেজ রয়েছে কিনা। এই অনিশ্চয়তা ভারতে ব্যাপক আকারে আন্ডার-ইনসুরেন্স বা অপর্যাপ্ত বীমা কভারেজের ইঙ্গিত দেয়, যা অনেক মানুষকে আর্থিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফেলতে পারে, যদিও তাঁদের কাছে এক বা একাধিক বীমা পলিসি রয়েছে।
বহু পলিসি, কম বোঝাপড়া:
সমীক্ষার তথ্যে উঠে এসেছে, ৭১ শতাংশ উত্তরদাতা দুই থেকে পাঁচটি সক্রিয় বীমা পলিসির মালিক, যেখানে জীবনবীমা (Life Insurance) সবচেয়ে সাধারণ (৬৩ শতাংশ), এরপর স্বাস্থ্যবীমা (২৪ শতাংশ) এবং মোটরবীমা (১৩ শতাংশ)। কিন্তু পলিসি থাকার পরও বাস্তব চিত্র হল—৬৫ শতাংশ মানুষ স্বীকার করেছেন যে তাঁরা তাঁদের পলিসির সুবিধা, বাদ (exclusions), এবং ক্লেম প্রসেস সংক্রান্ত বিষয়ে খুব কমই জানেন বা একেবারেই জানেন না।
শুধুমাত্র ৩৫ শতাংশ পলিসিধারী দাবি করেছেন যে তাঁরা তাঁদের বীমা পলিসির সমস্ত দিক ভালভাবে বোঝেন। এই বিভ্রান্তি এবং অনভিজ্ঞতা বীমার মূল উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবারের সদস্যরাও জানেন না কভারেজের কথা:
সমীক্ষা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে—৬০ শতাংশ পরিবারের নির্ভরশীল সদস্য জানেন না যে তাঁরা কোনও বীমা পলিসির আওতায় আছেন। আরও উদ্বেগের বিষয়, মাত্র ১০ শতাংশ নির্ভরশীল সঠিকভাবে তাঁদের কভারেজ বা বেনিফিট সম্পর্কে বলতে পারেন। এই অনবগতির ফলে প্রায়শই ক্লেম দাখিল না করা, ক্লেম প্রত্যাখ্যান, কিংবা পলিসির অকার্যকর ব্যবহার দেখা যায়।
বিভ্রান্ত ও বিচ্ছিন্ন পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষণ:
বীমা ডকুমেন্ট সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও বিশৃঙ্খল চিত্র ধরা পড়েছে। উত্তরদাতাদের মধ্যে—
২৯ শতাংশ এখনও ফিজিক্যাল ফাইলে বীমা কাগজ রাখেন
২৬ শতাংশ স্প্রেডশিট ব্যবহার করেন
২৪ শতাংশ SMS নোটিফিকেশনের ওপর নির্ভর করেন
২১ শতাংশ ডিজিটাল ফোল্ডারে তথ্য সংরক্ষণ করেন
এই বিচ্ছিন্ন পদ্ধতির কারণে জরুরি সময়ে তথ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং অনেক সময় ক্লেম প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
বীমা পরামর্শ বিষয়ে বিভ্রান্তি:
সমীক্ষা অনুযায়ী, ৩৬ শতাংশ মানুষ বীমা সংক্রান্ত সহায়তার জন্য মানবিক পরামর্শদাতাকে (human advisor) পছন্দ করেন। অন্যদিকে, ২৬ শতাংশ ডিজিটাল সহায়তা গ্রহণে আগ্রহী। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, ৩৮ শতাংশ মানুষ মনে করেন তাঁদের কোনও সহায়তার প্রয়োজন নেই, যদিও তাঁদের অধিকাংশই তাঁদের বীমা পলিসি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখেন না। এটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, ধারণাগত ও বাস্তব বীমা সচেতনার মধ্যে একটি বড় ফাঁক রয়েছে।
বিশেষজ্ঞের মন্তব্য:
এই পরিস্থিতি নিয়ে CoverSure-এর প্রতিষ্ঠাতা ও CEO, বিজয়ভারগিয়া বলেন, “যদি পলিসিধারীরা না জানেন যে কী কভার হচ্ছে বা কীভাবে ক্লেম করতে হয়, তাহলে বীমার আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়। পলিসি মালিকানা যতই বাড়ুক না কেন, প্রকৃত আর্থিক সুরক্ষা তখনই আসে যখন পলিসিধারী ও তাঁদের পরিবার জানেন যে তাঁদের বীমা কী সুবিধা দিচ্ছে।”
সচেতনতা বৃদ্ধির জরুরি প্রয়োজন:
এই সমীক্ষা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে ভারতে বীমা সচেতনতা এবং বীমা শিক্ষার ওপর আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। শুধু পলিসি কেনা যথেষ্ট নয়, বরং তার শর্ত, সুবিধা, সীমাবদ্ধতা এবং ক্লেম প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নইলে বিপদের সময় বীমা থাকার পরেও আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।
এই রিপোর্ট একটি বাস্তব ও অপ্রিয় চিত্র তুলে ধরেছে। অনেক ভারতীয় নিজেদের এবং পরিবারের জন্য বীমা কিনছেন ঠিকই, কিন্তু সেই বীমার প্রকৃত কার্যকারিতা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে, প্রয়োজনে তার সদ্ব্যবহার করতে পারছেন না।
এই অবস্থার পরিবর্তনে প্রয়োজন সরকারের, বীমা কোম্পানির এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর সম্মিলিত সচেতনতামূলক উদ্যোগ—যার লক্ষ্য হওয়া উচিত, “পলিসি কেনা নয়, বোঝা ও প্রয়োগ করাই আসল বীমা”।