ব্যক্তিগত ঋণ (Personal Loan) আজকাল অনেকের জন্য জরুরি আর্থিক চাহিদা মেটানোর একটি জনপ্রিয় উপায় হয়ে উঠেছে। চিকিৎসা জরুরি অবস্থা, শিক্ষার খরচ, বিয়ের আয়োজন কিংবা ঋণ পরিশোধের মতো বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষ ব্যক্তিগত ঋণের উপর নির্ভর করছে। কিন্তু এই ঋণ নিয়ে এখনও অনেক ভুল ধারণা বা মিথ প্রচলিত রয়েছে, যা মানুষকে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করছে এবং আর্থিক ক্ষতির কারণ হচ্ছে। ২০২৫ সালে এই মিথগুলো আপনার পকেটে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এই নিবন্ধে আমরা ৭টি সাধারণ মিথ ভেঙে ফেলব এবং সত্যতা তুলে ধরব, যাতে আপনি ব্যক্তিগত ঋণ নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
মিথ ১: ব্যক্তিগত ঋণ শুধুমাত্র জরুরি অবস্থার জন্য
সত্যতা: অনেকে মনে করেন ব্যক্তিগত ঋণ শুধুমাত্র চিকিৎসা জরুরি অবস্থা বা আর্থিক সংকটের সময় নেওয়া যায়। কিন্তু ব্যক্তিগত ঋণ একটি নমনীয় আর্থিক সরঞ্জাম। আপনি এটি বাড়ির সংস্কার, ভ্রমণ, শিক্ষার খরচ, এমনকি ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্যও ব্যবহার করতে পারেন। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাধারণত ঋণের ব্যবহার সম্পর্কে প্রশ্ন করে না। তবে, ঋণের পরিমাণ এবং পরিশোধের ক্ষমতা বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে অপ্রয়োজনীয় ঋণের ফাঁদে না পড়েন।
মিথ ২: ব্যক্তিগত ঋণ নিতে ভালো ক্রেডিট স্কোর আবশ্যক
সত্যতা: ভালো ক্রেডিট স্কোর (৭৫০ বা তার বেশি) থাকলে কম সুদে এবং ভালো শর্তে ঋণ পাওয়া সহজ হয়, তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়। ২০২৫ সালে অনেক ব্যাংক এবং নন-ব্যাংকিং ফাইনান্সিয়াল কোম্পানি (এনবিএফসি) মাঝারি বা নিম্ন ক্রেডিট স্কোরধারীদের জন্যও ঋণ প্রদান করছে। তবে, এই ক্ষেত্রে সুদের হার বেশি হতে পারে। আপনার আয়ের প্রমাণ এবং পরিশোধের ক্ষমতা থাকলে, ক্রেডিট স্কোর কম থাকলেও ঋণ পাওয়া সম্ভব।
মিথ ৩: ব্যক্তিগত ঋণ নিলে সবসময় উচ্চ সুদ দিতে হয়
সত্যতা: ব্যক্তিগত ঋণের সুদের হার সাধারণত ১০% থেকে ২৪% এর মধ্যে থাকে, যা সুরক্ষিত ঋণের (যেমন গাড়ি বা বাড়ির ঋণ) তুলনায় বেশি হতে পারে। কিন্তু এটি সবসময় ব্যয়বহুল নয়। ২০২৫ সালে প্রতিযোগিতার কারণে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান কম সুদে ঋণ অফার করছে। এছাড়া, ভালো ক্রেডিট স্কোর, স্থিতিশীল আয় এবং সঠিক তুলনার মাধ্যমে আপনি সাশ্রয়ী ঋণ পেতে পারেন। বিভিন্ন ব্যাংকের সুদের হার এবং প্রক্রিয়াকরণ ফি তুলনা করলে আপনি সেরা ডিলটি পেতে পারেন।
মিথ ৪: ব্যক্তিগত ঋণ পাওয়া খুব জটিল এবং সময়সাপেক্ষ
সত্যতা: অতীতে ব্যক্তিগত ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়া জটিল ছিল, কিন্তু ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের যুগে এটি এখন অনেক সহজ। ২০২৫ সালে বেশিরভাগ ব্যাংক এবং এনবিএফসি অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়া চালু করেছে, যেখানে আপনি মাত্র কয়েকটি ক্লিকে ঋণের জন্য আবেদন করতে পারেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ব্যাংক স্টেটমেন্ট) ডিজিটালভাবে জমা দেওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে, ঋণের অনুমোদন এবং টাকা হস্তান্তর ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হয়। প্রাক-অনুমোদিত ঋণের ক্ষেত্রে এই সময় আরও কম হতে পারে।
মিথ ৫: ব্যক্তিগত ঋণ আপনাকে ঋণের ফাঁদে ফেলে
সত্যতা: অনেকে মনে করেন ব্যক্তিগত ঋণ নিলে তা ঋণের ফাঁদে ফেলে দেয়। কিন্তু এটি আপনার আর্থিক পরিকল্পনার উপর নির্ভর করে। যদি আপনি আপনার আয় এবং খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঋণ নেন এবং সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করেন, তবে এটি কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। ২০২৫ সালে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান নমনীয় পরিশোধের মেয়াদ এবং কম মাসিক কিস্তির (EMI) সুবিধা দিচ্ছে। তবে, অপ্রয়োজনীয় ঋণ নেওয়া বা পরিশোধের ক্ষমতার বাইরে ঋণ নেওয়া এড়িয়ে চলুন।
মিথ ৬: সব ব্যক্তিগত ঋণ একই রকম
সত্যতা: সব ব্যক্তিগত ঋণ এক নয়। বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সুদের হার, প্রক্রিয়াকরণ ফি, মেয়াদ এবং শর্তে ঋণ প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু প্রতিষ্ঠান প্রাক-পরিশোধের জন্য কোনো জরিমানা চাপায় না, আবার কিছু প্রতিষ্ঠানে এই ফি থাকতে পারে। এছাড়া, কিছু ঋণে অতিরিক্ত সুবিধা যেমন বীমা কভার বা ক্রেডিট কার্ড অফার থাকতে পারে। তাই, ঋণ নেওয়ার আগে বিভিন্ন বিকল্প তুলনা করা গুরুত্বপূর্ণ।
মিথ ৭: ব্যক্তিগত ঋণ আপনার ক্রেডিট স্কোর নষ্ট করে
সত্যতা: এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ব্যক্তিগত ঋণ সঠিকভাবে পরিচালনা করলে আপনার ক্রেডিট স্কোর উন্নত হতে পারে। সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করলে এটি আপনার ক্রেডিট ইতিহাসে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে, যদি আপনি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হন বা দেরি করেন, তবে তা আপনার ক্রেডিট স্কোরের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ২০২৫ সালে ক্রেডিট ব্যুরোগুলো আরও উন্নত হয়েছে, এবং তারা আপনার পরিশোধের ধরনের উপর ভিত্তি করে স্কোর নির্ধারণ করে। তাই, ঋণ নেওয়ার আগে আপনার আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনা করুন।
কীভাবে সঠিক ব্যক্তিগত ঋণ নেবেন?
১. প্রয়োজন নির্ধারণ: ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ করুন এবং অপ্রয়োজনীয় ঋণ এড়িয়ে চলুন।
২. তুলনা করুন: বিভিন্ন ব্যাংক ও এনবিএফসির সুদের হার, ফি এবং শর্ত তুলনা করুন। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এই তুলনা সহজ করেছে।
৩. কাগজপত্র প্রস্তুত: আধার কার্ড, প্যান কার্ড, আয়ের প্রমাণ এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট প্রস্তুত রাখুন।
৪. অনলাইন আবেদন: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আবেদন করলে সময় বাঁচবে।
৫. পরিশোধের পরিকল্পনা: আপনার মাসিক আয়ের ৪০-৫০% এর বেশি কিস্তি বেছে নেবেন না।
একটি বাস্তব উদাহরণ
ধরুন, রিয়া নামে একজন ব্যক্তি তার বোনের বিয়ের জন্য ৩ লাখ টাকার ব্যক্তিগত ঋণ নিতে চান। তিনি ভেবেছিলেন যে উচ্চ সুদের কারণে ঋণ নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু তিনি বিভিন্ন ব্যাংকের অফার তুলনা করে একটি ১১% সুদের হারে ঋণ পান। ৩৬ মাসের কিস্তিতে তার মাসিক EMI হয় ৯,৯০০ টাকা, যা তার আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করে তিনি তার ক্রেডিট স্কোরও উন্নত করেন।
২০২৫ সালে ব্যক্তিগত ঋণ সম্পর্কে এই মিথগুলো আপনাকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে এবং আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। সঠিক তথ্য এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ঋণ আপনার আর্থিক লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হতে পারে। তাই, ঋণ নেওয়ার আগে সব শর্ত ভালোভাবে যাচাই করুন, আপনার প্রয়োজন এবং পরিশোধের ক্ষমতা বিবেচনা করুন, এবং সঠিক ঋণদাতা নির্বাচন করুন। আরও তথ্যের জন্য আপনার ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট দেখুন।