ভারত সরকারের কর্মচারীদের বেতন ও ভাতার কাঠামো পর্যালোচনা ও সংশোধনের জন্য প্রতি দশকে একবার কেন্দ্রীয় বেতন কমিশন (Pay Commission) গঠন করা হয়। এই কমিশনগুলো মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং কর্মচারীদের প্রয়োজনের ভিত্তিতে বেতন, ভাতা এবং পেনশনের সুপারিশ করে। ষষ্ঠ বেতন কমিশন (২০০৬), সপ্তম বেতন কমিশন (২০১৬) এবং অষ্টম বেতন কমিশন (২০২৬ থেকে কার্যকর) কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। তবে, কোন কমিশন সবচেয়ে বেশি সুবিধা এনেছে? এই প্রতিবেদনে আমরা ষষ্ঠ, সপ্তম এবং অষ্টম বেতন কমিশনের তুলনা করে দেখব কোনটি কর্মচারীদের জন্য বেশি লাভজনক ছিল বা হবে।
ষষ্ঠ বেতন কমিশন (২০০৬)
ষষ্ঠ বেতন কমিশন ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছিল। এটি বিচারপতি বি.এন. শ্রীকৃষ্ণের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল এবং এর সুপারিশ মার্চ ২০০৮-এ জমা দেওয়া হয়। এই কমিশন পে-ব্যান্ড এবং গ্রেড পে-এর একটি নতুন কাঠামো প্রবর্তন করে, যা পূর্ববর্তী বেতন কাঠামোর তুলনায় স্বচ্ছতা বাড়ায়।
- ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর: ১.৮৬ (প্রাথমিকভাবে ১.৭৪ প্রস্তাবিত, পরে সংশোধিত)।
- ন্যূনতম মূল বেতন: ৫ম সিপিসি-র ২,৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭,০০০ টাকা করা হয়, অর্থাৎ ১৫৪% বৃদ্ধি।
- ন্যূনতম পেনশন: ১,২৭৫ টাকা থেকে ৩,৫০০ টাকায় উন্নীত, অর্থাৎ ১৭৫% বৃদ্ধি।
- ভাতা: মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) ১৬% থেকে ২২%-এ উন্নীত। হাউস রেন্ট অ্যালাউন্স (এইচআরএ) এবং ট্রান্সপোর্ট অ্যালাউন্সের নতুন বিধান চালু হয়।
- অন্যান্য সুবিধা: ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য রিস্ক ইনস্যুরেন্স প্রবর্তন করা হয়, যা পূর্ববর্তী রিস্ক অ্যালাউন্সের বিকল্প।
- প্রভাব: এই কমিশনের ফলে সরকারি বেতন ব্যয় ৪৬% বৃদ্ধি পায়, যা প্রায় ২০,০০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত বোঝা সৃষ্টি করে। নিম্ন-স্তরের কর্মচারীদের জন্য এটি উল্লেখযোগ্য আর্থিক স্থিতিশীলতা এনেছিল। তবে, আইএএস-এর মতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের বেতন বেসরকারি খাতের তুলনায় কম বলে সমালোচনা করেছিলেন।
সপ্তম বেতন কমিশন (২০১৬)
সপ্তম বেতন কমিশন ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গঠিত হয় এবং ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। বিচারপতি এ.কে. মাথুরের নেতৃত্বে এই কমিশন পে-ম্যাট্রিক্স নামে একটি নতুন বেতন কাঠামো প্রবর্তন করে, যা পূর্ববর্তী পে-ব্যান্ড এবং গ্রেড পে-এর জটিলতা দূর করে।
- ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর: ২.৫৭, যা সমস্ত স্তরে অভিন্নভাবে প্রয়োগ করা হয়।
- ন্যূনতম মূল বেতন: ৭,০০০ টাকা থেকে ১৮,০০০ টাকায় উন্নীত, অর্থাৎ ১৫৭% বৃদ্ধি।
- ন্যূনতম পেনশন: ৩,৫০০ টাকা থেকে ৯,০০০ টাকায় বৃদ্ধি, অর্থাৎ ১৫৭% বৃদ্ধি।
- ভাতা: ডিএ পুনর্বিন্যাস করা হয় এবং এইচআরএ ২৪-৩০% পর্যন্ত সংশোধিত হয়। স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প চালু হয়।
- অন্যান্য সুবিধা: পেনশন গণনার জন্য দুটি পদ্ধতি (ইনক্রিমেন্ট মেথড এবং ফিটমেন্ট মেথড) প্রবর্তন করা হয়। এছাড়া, পেনশনারদের জন্য সিজিএইচএস-এর বাইরে ক্যাশলেস চিকিৎসা সুবিধা চালু হয়।
- প্রভাব: সামগ্রিকভাবে বেতন, ভাতা এবং পেনশনে ২৩.৫৫% বৃদ্ধি ঘটে, যা প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার অতিরিক্ত ব্যয় সৃষ্টি করে। নিম্ন এবং মধ্য-স্তরের কর্মচারীরা এই কমিশন থেকে বেশি সুবিধা পেয়েছেন। তবে, ১৪.২৭% কার্যকর বেতন বৃদ্ধি পূর্ববর্তী কমিশনের তুলনায় কম বলে সমালোচিত হয়।
অষ্টম বেতন কমিশন (২০২৬)
অষ্টম বেতন কমিশন ২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি ঘোষিত হয়েছে এবং ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই কমিশনের চেয়ারপার্সন এবং সদস্যদের নিয়োগ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে, প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এটি ৪৮.৬২ লাখ কর্মচারী এবং ৬৭.৮৫ লাখ পেনশনভোগীদের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে।
- ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর: ২.২৮ থেকে ২.৮৬ এর মধ্যে প্রস্তাবিত। কিছু রিপোর্টে ৩.৬৮ এর কথাও উল্লেখ রয়েছে, যা উচ্চাকাঙ্ক্ষী।
- ন্যূনতম মূল বেতন: ১৮,০০০ টাকা থেকে ৪১,০৪০ টাকা (২.২৮ ফিটমেন্টে) বা ৫১,৪৮০ টাকা (২.৮৬ ফিটমেন্টে) হতে পারে। এটি ১২৮-১৮৬% বৃদ্ধি নির্দেশ করে।
- ন্যূনতম পেনশন: ৯,০০০ টাকা থেকে ২০,৫২০ টাকা (২.২৮ ফিটমেন্টে) বা ২৫,৭৪০ টাকা (২.৮৬ ফিটমেন্টে) হতে পারে।
- ভাতা: ডিএ ২০২৬ সালে ০% এ রিসেট হবে, তবে মুদ্রাস্ফীতির সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুত বাড়বে। এইচআরএ ৩০-৩৫% পর্যন্ত বাড়তে পারে।
- অন্যান্য সুবিধা: উন্নত পেনশন সিস্টেম এবং ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেম (এনপিএস) সংস্কার প্রত্যাশিত।
- প্রভাব: ২০-৩৫% বেতন বৃদ্ধি প্রত্যাশিত, যা ১.৮-৩.২ লাখ কোটি টাকার অতিরিক্ত ব্যয় সৃষ্টি করতে পারে। নিম্ন-স্তরের কর্মচারীদের জন্য বেশি সুবিধা প্রত্যাশিত।
তুলনা এবং কে বেশি লাভবান?
- ষষ্ঠ বেতন কমিশন: নিম্ন এবং মধ্য-স্তরের কর্মচারীদের জন্য ৪০% কার্যকর বেতন বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য ছিল। তবে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তুলনামূলকভাবে কম সুবিধা পেয়েছেন। পেনশনাররা ১৭৫% বৃদ্ধি পেয়েছেন, যা তাদের জীবনযাত্রায় বড় পরিবর্তন এনেছে।
- সপ্তম বেতন কমিশন: ২৩.৫৫% সামগ্রিক বৃদ্ধি এবং ১৪.২৭% কার্যকর বেতন বৃদ্ধি ষষ্ঠ কমিশনের তুলনায় কম ছিল। নিম্ন-স্তরের কর্মচারীরা (লেভেল ১-৫) বেশি সুবিধা পেয়েছেন, তবে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এবং পেনশনাররা কম বৃদ্ধির জন্য সমালোচনা করেছেন।
- অষ্টম বেতন কমিশন: প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০-৩৫% বেতন বৃদ্ধি এবং ২.২৮-২.৮৬ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর নিম্ন এবং মধ্য-স্তরের কর্মচারীদের (গ্রুপ সি এবং বি) জন্য বেশি সুবিধাজনক হবে। পেনশনারদের জন্য ৩০% বৃদ্ধি প্রত্যাশিত, যা ষষ্ঠ কমিশনের তুলনায় কম কিন্তু সপ্তম কমিশনের তুলনায় বেশি।
কে বেশি লাভবান?
- নিম্ন-স্তরের কর্মচারী (গ্রুপ সি): ষষ্ঠ কমিশনে ৪০% বৃদ্ধি এবং সপ্তম কমিশনে ১৫৭% ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধি নিম্ন-স্তরের কর্মচারীদের জন্য বড় সুবিধা এনেছিল। অষ্টম কমিশনে ১২৮-১৮৬% বৃদ্ধি প্রত্যাশিত, যা এই গ্রুপের জন্য সবচেয়ে বেশি লাভজনক হতে পারে।
- মধ্য-স্তরের কর্মচারী (গ্রুপ বি): ষষ্ঠ এবং সপ্তম কমিশনে মাঝারি সুবিধা পেয়েছেন। অষ্টম কমিশনে উচ্চ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টরের কারণে তারা উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাবেন।
- পেনশনার: ষষ্ঠ কমিশনে ১৭৫% পেনশন বৃদ্ধি ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। সপ্তম কমিশনে ১৫৭% বৃদ্ধি এবং অষ্টম কমিশনে ৩০% বৃদ্ধি প্রত্যাশিত, যা তুলনামূলকভাবে কম।
- উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা: তিনটি কমিশনেই তুলনামূলকভাবে কম সুবিধা পেয়েছেন, কারণ বেসরকারি খাতের তুলনায় তাদের বেতন বৃদ্ধি কম ছিল।
ষষ্ঠ বেতন কমিশন নিম্ন-স্তরের কর্মচারী এবং পেনশনারদের জন্য সবচেয়ে লাভজনক ছিল, বিশেষ করে ৪০% কার্যকর বৃদ্ধি এবং ১৭৫% পেনশন বৃদ্ধির কারণে। সপ্তম কমিশন নিম্ন-স্তরের কর্মচারীদের জন্য উল্লেখযোগ্য সুবিধা এনেছে, তবে কার্যকর বৃদ্ধি কম ছিল। অষ্টম কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিম্ন এবং মধ্য-স্তরের কর্মচারীরা সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবেন, বিশেষ করে যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ বা তার বেশি হয়। তবে, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং বাস্তবায়নের সময়সীমা এই সুবিধাগুলোর পরিমাণ নির্ধারণ করবে।