আর্থিক স্বাধীনতা (Financial Freedom) আজকের তরুণ প্রজন্মের অন্যতম বড় লক্ষ্য। প্রত্যেকেই চায় এমন এক অবস্থায় পৌঁছতে, যেখানে চাকরি বা অন্য কারও ওপর নির্ভর না করেই জীবনযাপন করা সম্ভব হয়। সাধারণত এই স্বপ্ন পূরণের জন্য আমরা বাজেট তৈরি, সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের কথা বেশি শুনি। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা প্রায়শই উপেক্ষিত হয়, তা হল জীবনবিমা (Life Insurance)। আর্থিক স্থিতি গড়ে তোলার পথে জীবনবিমা শুধুমাত্র সুরক্ষা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে সম্পদ সৃষ্টিরও একটি শক্ত ভিত।
বেশিরভাগ তরুণ পেশাদার বা পরিকল্পনাকারীরা মনে করেন, জীবনের ৩০ বা ৪০ বছরের আগে বিমার প্রয়োজন নেই। কারণ তখনও তাঁদের দায়িত্ব কম থাকে কিংবা তাঁরা ভাবেন এটি কেবল অর্থের অপচয়। বাস্তবে এটি এক বড় ভুল। বিমা যত আগে কেনা যায়, প্রিমিয়াম তত কম হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে, ফলে বিমা নেওয়া কঠিন হয় এবং প্রিমিয়ামও বেড়ে যায়। সবচেয়ে বড় বিষয় হল, বিমা ছাড়া হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা বা অঘটন মুহূর্তে আপনার গড়ে তোলা সঞ্চয় এবং আর্থিক পরিকল্পনা ভেঙে দিতে পারে।
অনেকে আবার শুধুমাত্র টার্ম ইন্স্যুরেন্সে (Term Insurance) ভরসা রাখেন। নিঃসন্দেহে টার্ম প্ল্যান সস্তায় বেশি কভার দেয়, কিন্তু সবক্ষেত্রে এটি যথেষ্ট নয়। অন্যান্য পরিকল্পনা যেমন এন্ডাওমেন্ট পলিসি (Endowment Policy) বা ইউনিট লিঙ্কড ইন্স্যুরেন্স প্ল্যান (ULIP) বিমা ও বিনিয়োগকে একত্রিত করে। এগুলি দীর্ঘমেয়াদে সম্পদ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং অবসরের পরিকল্পনাতেও ভূমিকা রাখে। ফলে বিমাকে কেবল মৃত্যুর পর সুরক্ষা নয়, বরং আর্থিক বৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে দেখা উচিত।
অনেকেই বিমার পরিমাণ ঠিক করার সময় ভুল করেন। তাঁরা যা সামর্থ্যের মধ্যে মনে করেন, সেই অঙ্কেই সীমাবদ্ধ থাকেন। অথচ বিমার কভারেজ ideally হওয়া উচিত আপনার ভবিষ্যতের আয়ের সমান, যাতে পরিবারের প্রয়োজন মেটানো যায়। এর মধ্যে ঋণ শোধ, সন্তানের পড়াশোনা, পরিবার চালানোর খরচ সবই অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত। যদি কভারেজ কম হয়, তবে বিমার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়।
অনেকে মনে করেন, বিবাহ না হলে বা নির্ভরশীল কেউ না থাকলে জীবনবিমার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। যদি আপনার কোনো ঋণ থাকে, অথবা আপনি চান বাবা-মা কিংবা কোনো প্রিয় উদ্দেশ্যের জন্য অর্থ রেখে যেতে, বিমা সাহায্য করতে পারে। এছাড়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো খরচও বিমা থেকে মেটানো যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তরুণ বয়সে বিমা কিনলে কম প্রিমিয়ামে দীর্ঘমেয়াদে বড় সুবিধা পাওয়া যায়।
আমরা অনেকেই সঞ্চয়, বিনিয়োগ বা কর পরিকল্পনার দিকে নজর দিই, কিন্তু বিমাকে আলাদা রাখি। অথচ জীবনবিমা আর্থিক পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি শুধু সুরক্ষাই দেয় না, কিছু ক্ষেত্রে লোন নেওয়ার সুযোগ, ম্যাচুরিটি বেনিফিট এবং কর সাশ্রয়ের সুবিধাও দেয়। একে যদি সঠিকভাবে সমন্বয় করা যায়, তবে সামগ্রিক আর্থিক কৌশল আরও দৃঢ় হয়।
অনেকে মনে করেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রচুর টাকা থাকলেই আর্থিক স্বাধীনতা আসে। কিন্তু আসল স্বাধীনতা হল ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা, জীবনকে নিজের মতো করে গড়ে তোলার ক্ষমতা রাখা। জীবনবিমা সেই নিশ্চিন্ততার নিরাপত্তা জাল। যেকোনো অঘটনের পরও এটি নিশ্চিত করে যে আপনি এবং আপনার পরিবার আর্থিক স্বাধীনতার পথে এগিয়ে চলতে পারবেন।
আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য শুধু আয় এবং বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়। জীবনবিমা সেই নিরাপত্তার স্তম্ভ, যা আপনার সম্পদকে রক্ষা করে এবং পরিবারের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে। তাই জীবনের প্রাথমিক পর্যায়েই বিমাকে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। মনে রাখতে হবে—জীবনবিমা কোনো খরচ নয়, বরং এটি একটি বিনিয়োগ, যা আর্থিক স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সাহায্য করে।