ভারতের চিকিৎসা সরঞ্জাম খাত নিয়ে কাজ করা শিল্পসংগঠন অল ইন্ডিয়া মেডিকেল ডিভাইস ইন্ডাস্ট্রি (AiMeD) সম্প্রতি কেন্দ্রকে সতর্ক করে জানিয়েছে যে, আসন্ন পণ্য ও পরিষেবা কর (GST) হারের পরিবর্তন দেশীয় প্রস্তুতকারকদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বর্তমানে বেশিরভাগ মেডিকেল ডিভাইসের উপর ১২ শতাংশ জিএসটি ধার্য করা হয়। কিন্তু এই সরঞ্জাম তৈরি করতে যে কাঁচামাল ও উপকরণ ব্যবহৃত হয়, সেগুলির উপর করের হার ১৮ শতাংশ। ফলে একটি “inverted duty structure” বা উল্টোদিকের শুল্ক কাঠামো তৈরি হয়েছে, যা দেশীয় শিল্পের উপর মারাত্মক চাপ ফেলছে।
AiMeD-এর ফোরাম কো-অর্ডিনেটর রাজীব নাথ জানিয়েছেন, সরকার যদি জিএসটি হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনে, তবে উচ্চমূল্যের যন্ত্রপাতি যেমন ইকুইপমেন্ট, ইলেকট্রনিক ডিভাইস, রিএজেন্ট এবং ইমপ্লান্ট আরও সহজলভ্য হবে এবং বাজারে এদের বিস্তার ঘটবে। এতে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবার খরচও কিছুটা কমবে।
তবে অন্যদিকে, কম দামের ব্যবহারযোগ্য সরঞ্জাম বা “low-margin consumables” যেমন সিরিঞ্জ, ক্যাথেটার, ইনট্রাভেনাস সেট ইত্যাদির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কর আরোপ করলে সমস্যা আরও বাড়বে। কারণ এই পণ্যের উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণের উপর এখনো ১৮ শতাংশ কর বহাল থাকবে। ফলে দেশীয় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে এবং বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য তুলনামূলকভাবে সস্তা হয়ে বাজার দখল করতে পারে।
অন্যদিকে যদি করের হার ১৮ শতাংশ করা হয়, তবে তা সরাসরি হাসপাতাল এবং গৃহস্থালির চিকিৎসা খরচ বাড়িয়ে দেবে। তাই সংগঠনটির দাবি, সরকারকে সতর্ক ও পরিমিত নীতি গ্রহণ করতে হবে।
AiMeD-এর প্রস্তাব, অধিকাংশ কনজিউমেবল পণ্যের ক্ষেত্রে বর্তমান ১২ শতাংশ হারে কর বহাল রাখা উচিত। এতে একদিকে দেশীয় উৎপাদকদের খরচের চাপ কিছুটা কমবে, অন্যদিকে আমদানিকৃত পণ্যের দাপটও সীমিত করা সম্ভব হবে। তবে উচ্চমূল্যের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হারে জিএসটি প্রযোজ্য করলে দেশীয় শিল্পের বাজার বিস্তার ঘটতে পারে।
রাজীব নাথ স্পষ্টভাবে বলেন, “একটি সমন্বিত কাঠামো প্রয়োজন যেখানে ভোক্তাদের জন্য চিকিৎসা সেবার খরচ সাশ্রয়ী হবে, আবার দেশীয় উৎপাদকদেরও টিকে থাকার সুযোগ থাকবে।”
EY-এর ২০২৪ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের মেডটেক বাজারের আকার বর্তমানে প্রায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০৩০ সালের মধ্যে এই খাতের আকার ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। বৈশ্বিক মেডটেক বাজারে ভারতের অংশীদারিত্ব বর্তমানে মাত্র ১.৬৫% হলেও আগামী ২৫ বছরের মধ্যে তা ১০-১২ শতাংশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব, নীতিগত কোনো ভুল পদক্ষেপ দেশীয় শিল্পের অগ্রগতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
AiMeD-এর মতে, জিএসটি হার ১৮ শতাংশ করলে সরাসরি চিকিৎসা সামগ্রীর দাম বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত রোগীদের বহন করতে হবে। আবার একেবারে ৫ শতাংশ করলে উৎপাদকরা লোকসানের মুখে পড়বে এবং দেশীয় সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল হবে। ফলে পণ্যের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করবে।
তাই সংগঠনটির দাবি, এমন একটি “calibrated tax structure” প্রয়োজন যা একদিকে রোগীদের জন্য সাশ্রয়ী, অন্যদিকে উৎপাদকদের জন্য টেকসই পরিবেশ সৃষ্টি করে।
AiMeD আরও প্রস্তাব দিয়েছে যে, সরকারকে জিএসটি রিফান্ডের প্রক্রিয়া সরল করতে হবে। বর্তমানে ইনপুট সার্ভিস ও ক্যাপিটাল গুডসের উপর প্রদত্ত কর ফেরত পাওয়া যায় না, যা উৎপাদকদের নগদ প্রবাহে সমস্যার সৃষ্টি করছে। যদি এই রিফান্ড ব্যবস্থা সহজ ও কার্যকর করা হয়, তবে দেশীয় শিল্পের উপর চাপ কিছুটা লাঘব হবে।
ভারতীয় উৎপাদকরা ইতিমধ্যেই চীন ও আসিয়ান দেশের পণ্যের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি খরচে উৎপাদন করছে। এই “cost disability” বা ব্যয়গত দুর্বলতা দেশীয় শিল্পকে পিছিয়ে দিচ্ছে। রাজীব নাথের ভাষায়, “জিএসটি নীতি এমন হওয়া উচিত যা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগকে শক্তিশালী করে, দুর্বল নয়।”
ভারতের মেডটেক শিল্প একদিকে প্রবল সম্ভাবনা নিয়ে এগোচ্ছে, অন্যদিকে নীতি নির্ধারণে সামান্য ভুল পদক্ষেপও এর প্রবৃদ্ধিকে বড় আঘাত করতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সরকারকে এখন এমন একটি ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে রোগী, ভোক্তা এবং উৎপাদক—সবার স্বার্থ রক্ষা হয়।
মেডিকেল ডিভাইস শিল্প শুধুমাত্র অর্থনৈতিক খাত নয়, এটি দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের সঙ্গেও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। সুতরাং জিএসটি কাঠামো নিয়ে সরকারের আসন্ন সিদ্ধান্ত ভারতের স্বাস্থ্যখাতের ভবিষ্যত নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।